পুরাণ বলে আদ্যা শক্তি মহামায়ার সৃষ্টি করেন ব্রহ্মা এবং পরে অন্যান্য দেবতাদের প্রদত্ত অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সকলের পুঞ্জীভূত শক্তি ও তেজ একত্র হয়ে অসুর নাশিনী দেবী দুর্গার সৃষ্টি । ঘটনার পারম্পর্য রক্ষা করেই তাই অসুরবিনাশিনী দুর্গার সমগ্র রূপ নির্মিত হয়েছে। দেবী দুর্গার চার সন্তানের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। দেবী দুর্গা আসলে বিশেষ একটি প্রতীক। কিভাবে? জানতে পারি পুরাণ থেকেই।
দেবী দুর্গার মূর্তি মাত্রেই দেখি, তাঁর একটি পা অন্ধকারের প্রতীক অসুরের ওপর, অন্য একটি পা সিংহের পিঠে – যে সিংহ দিবালোকের প্রতীক। দুর্গা এই দুইয়ের সন্ধিস্থল অর্থাৎ রাত্রি ও দিনের সংযোগকারী ঊষার প্রতীক। যে মুহূর্তে রাত্রি প্রভাত হয় তখনই দিনের প্রতীক সিংহ, রাত্রির প্রতীক অসুরকে বধ করে। ঊষার স্বর্ণ কিরণের আলোয় দেবী বিভূষিতা, তাই তাঁর গায়ের রঙে সোনালীর আভা। গণেশ ভোরবেলার দেবতা, তাই তাঁর রঙে আছে সূর্যের গোলাপি রং। তিনি প্রস্ফুটিত পদ্মের উপর বসে থাকেন। দেবী লক্ষ্মী সকালবেলার সূর্য কে প্রতীকায়িত করেন তাই তাঁকে পদ্মের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।
অন্যদিকে দেবী সরস্বতী প্রখর মধ্যাহ্নকে সূচিত করেন, তাই তাঁর গায়ের রঙ সবথেকে উজ্জ্বল – সাদা। আর কার্তিকেয় প্রতীকায়িত করেন অস্তমান সূর্যকে তাই তাঁর রঙ হলুদ।
দিবসের সূর্য অস্তমিত হলে জলে তার ছায়া পড়ে আবার পরদিন সেই ছায়ার আলপনা দিয়েই সূর্যোদয় হয়। এই চিরন্তন সত্যের প্রতিশ্রুতিতেই দুর্গামূর্তি জলে বিসর্জিতা হন যাতে আবারও তিনি ফিরে আসতে পারেন।
তাই বলতে পারি দুর্গাপুজো আসলে একটি ‘আইডিয়া’ আর আমরা নিত্যই সেই আইডিয়া থেকে পুষ্টি লাভ করছি। জ্ঞানত বা অজ্ঞানত।
সিনেমার পর্দায় বহুবার দেখেছি দুর্গাপুজো। বেশিরভাগ সময়েই তা মিলনোৎসবের সমার্থক হয়েছে, কিন্তু কখনো কখনো এর সঙ্গে মিলিত হয়েছি অন্যভাবে। ওই যে বললাম ‘আইডিয়া’! এখানেও ব্যাপারটা তাই।
মনে করে দেখুন, মাঠভরা কাশফুলের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলা অপু দুর্গা কে! দূর থেকে দেখছে, একরাশ কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মিলিয়ে যাচ্ছে রেলগাড়ি। কাশফুলগুলি আরও উজ্জ্বল দেখাচ্ছে পর্দায়। অন্ধকার মিলিয়ে ফুটে ওঠা আলোর মতন। এই দৃশ্যটি আরও কিছু বলে। অপু আর দুর্গা একসঙ্গেই ছুটতে শুরু করেছিল রেলগাড়ি দেখতে। কিন্তু কিছুটা এগিয়েই দুর্গা পড়ে যায়, ছুটে এগিয়ে গিয়ে একেবারে সামনে থেকে রেলগাড়ি দেখে একা অপু। কাশবনের দৃশ্যটির শুরু থেকেই অপুর মাথায় একটা মুকু্ট দেখতে পাই। রাংতা বসানো। মাথায় মুকুট পরে হাতে একটা কঞ্চি নিয়ে আনমনে পথে হেঁটে চলেছে । কোথায় পেল সে মুকুট? কাশফুল আর দুর্গাপুজো তো সমার্থক। তবে কি দেবীর বিসর্জন হয়ে গেছে? তাই ফেলে ছড়িয়ে পড়ে থাকা দেবীর অলংকার কুড়িয়ে নিয়ে খেলায় মেতেছে শিশু? যদি তাই ধরে নিই তবে এও এক প্রতীক। ছবির ঘটনায় এর কিছু পরেই মারা যায় অপুর দিদি দুর্গা। অর্থাৎ দেবী দুর্গার বিসর্জন প্রতীকায়িত করছে অপুর দিদি দুর্গার জীবনান্তকে। ছুটে যাওয়া রেলগাড়ি সেই জীবনগতির ইঙ্গিত, যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে পারেনি দুর্গা। এমন পরতে পরতে জড়িয়ে থাকা অমূল্য জীবনসংরাগেরই অন্য নাম – সত্যজিৎ রায়।
ছোটবেলায় ভবানীপুরের মামারবাড়িতে গরমের দুপুরে তিনি দেখতেন এক ম্যাজিক। ঘরের লাগোয়া বারান্দা তারপর রাস্তা। দুপুরে দরজা-জানলা বন্ধ অন্ধকার ঘরে খড়খড়ি দিয়ে ছিটকে আসা আলো বিশেষ একটা সময়ে দেওয়ালে উল্টো ছায়াছবির সৃষ্টি করত। গাড়ি, সাইকেল, রিক্সা, পথচারী সবকিছু দেখা যেত। আবার সদর দরজার ছোট ফুটোতে ঘষা কাঁচ বসিয়ে তার মধ্যে দিয়ে ছোট ছোট উল্টো ছবি দেখাও ছিল তাঁর নেশা। এই ম্যাজিক যে আসলে কি তা জানতে তাঁকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। আর সেদিনের সেই ম্যাজিকই ভবিষ্যতের চলচ্চিত্র স্রষ্টাকে পথ দেখিয়েছিল।
যে দৃশ্যটি এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করলাম বলা বাহুল্য সেটি তাঁর প্রথম সৃষ্ট ছবি পথের পাঁচালী’র।
কিন্তু তিনি যখন শিশু-কিশোর দর্শকদের কথা মনে রেখে ছবি নির্মাণ করছেন তখন তার চেহারাটা আলাদা। মনে পড়ে এই সংলাপটি?
“অসুরের বুকে ঘ্যাচাং করে বর্শা ঢুকে গেছে, আর গ্যাল গ্যাল করে রক্ত বেরিয়ে গেছে”
মা দুর্গার অসুরের গায়ে রঙ করার সময় ‘এক বাটি ভর্তি রক্ত’ দেখে শ্রীমান রুক্মিনীকুমার ওরফে রুকু বলেছিল এটি। ছবির নাম – জয় বাবা ফেলুনাথ। ১৯৭৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির গল্পটিতে জড়িয়ে আছে দুর্গাপুজোর দিনগুলি। বলা যায় এ ছবিতে মা দুর্গা আর তাঁর বাহন সিংহ এই দুই আধারেই লুকিয়ে রয়েছে রহস্যের মূল কাহিনি । সেখানে আফ্রিকার রাজা অর্থাৎ সিংহের মূর্তির মুখে চুয়িংগাম দিয়ে লাগানো গণেশ মূর্তি উদ্ধার না হলে, সেটি আটলান্টিস অর্থাৎ কিনা গঙ্গায় হারিয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা করেছে শ্রীমান রুকু। সত্যজিৎ রায় তাঁর এই ছবিতে পৌরাণিক দেবী দুর্গার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছিলেন। শিশু-কিশোর দর্শকদের জন্য একে এক সংক্ষিপ্ত পুরাণ পাঠ বললে খুব একটা ভুল হয় না। ছবি দেখতে বসলে অনায়াসেই তা মনে পাকাপাকি জায়গা করে নেয়।
ছবিতে প্রয়োজনীয় দুর্গা প্রতিমাটি তৈরি করা হয়েছিল বেনারসেই। মজার ব্যাপার হলো ফেলুদার গল্প নিয়ে তৈরি এই ছবিতে বারাণসীর গণেশ মহল্লার যে মৃৎশিল্পী মূর্তি গড়েছিলেন তিনিও ছিলেন ফেলুদা। সমাপতনটা আশ্চর্যজনক তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাঙালির সবথেকে প্রিয় বিনোদন, সবথেকে ঐতিহ্যবাহী উৎসব দুর্গাপুজো বারবারই ফিরে ফিরে এসেছে ছবির পর্দায় এবং আমরাও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি উৎসবকে পর্দায় উপভোগ করতে। উল্লিখিত দুটি চলচ্চিত্রতে যেমন সেটি দুটি ভিন্ন প্রকাশে উজ্জ্বল।
বলতে পারি, দেবী দুর্গার এ এক অন্য বোধন। আদ্যা শক্তি মহামায়া যেখানে অনন্য জীবনবোধের প্রতীক। অজ্ঞান মানুষ আমরা। দেবীমাহাত্ম্যের কতটুকুই বা জানি! হয়তো এই দৈবচেতনাই বিশেষ কিছু মানুষের বৌদ্ধিক চেতনাকে জাগ্রত করে এমন অসামান্য কিছু সৃষ্টি করিয়ে নিয়েছে? আর আমাদের মত সাধারণরা তার সারসত্যটুকু লাভ করে ধন্য হয়েছি !
All rights reserved © Kothabriksha 2020