(১)
শীতের বিকেল,পাঁচটা বাজে,সন্ধ্যে হয়ে আসে
তোমায় আমায় দেখা হলো কলেজ গেটের পাশে
“অমৃতা না?” ডাকলে তুমি,তাকাই আমি ফিরে
অন্ধকারে মুখ ঢেকে যায়,বললে তুমি,”কিরে?
চিনতে পারিস?” এগিয়ে এলে আমার কাছাকাছি
“সুমন্তদা! কেমন আছো?”,” আমরা ভালো আছি,
তোর কথা বল, কোন ইয়ারে? অনার্স নিলি নাকি?”
“প্রথম বর্ষ,পাইনি অনার্স”, চোখ নামিয়ে থাকি
“দাদার খবর?…এলাম তবে”, চললে কলেজমুখে
থমকে আছি,চমকে গেছি,কাঁপছি গভীর সুখে
দাদার বন্ধু সুমন্তদা, প্রথম ভালোলাগা
প্রথম ব্যথা, কান্না বালিশ,সমস্ত রাত জাগা
সেসব খবর কেউ জানেনা,আমিও ছিলাম ভুলে
আবার এলে দমকা বাতাস, বন্ধ আগল খুলে
শীতের বিকেল,পাঁচটা বাজে,সন্ধ্যে হয়ে আসে,
আবীর ওড়ে দখিন হাওয়ায়, পলাশ ঝরে ঘাসে।
(২)
দাদা তখন এম.এ পড়ে, আমার এইট সবে।
ফাগুন দিনের হলুদ বিকেল,সন্ধ্যে হবে হবে
প্রথম এলে শ্যামলা ছেলে, গালে নরম দাড়ি
দাদার বন্ধু, সুমন্ত নাম, আগরপাড়ায় বাড়ি।
অতল চোখের নিবিড় মায়া,প্রথম দেখা হলো
প্রহর শেষের আলোয় আমার নৌকো টলোমলো
আমার হঠাৎ বড় হওয়া, তোমার আসা যাওয়া,
তুমি তখন আকাশছোঁয়া, যায় না তোমায় পাওয়া
স্বপ্ন তবুও দিন রাত্তির ভিড় করে এই মনে
কান্না আসে যখন তখন মেঘলা ঘরের কোণে
খাতার পাতায় হিজিবিজি, রেজাল্টে লাল কালি
হয়না কথা কারোর সাথেই, গান শোনা হয় খালি
আমার বন্ধু দেবস্মিতা,বললো মিষ্টি হেসে,
দাদার বন্ধু ভীষণ বালাই,বড়ই সর্বনেশে!
(৩)
দুদিন পরে আবার দেখা, তবে এবার ক্লাসে
স্যোসিওলজি,দর্শন আর বাংলা ছিল পাসে।
বাংলা পড়াও সুমন্তস্যার, সপ্তাহে তিনবার
অন্য দুদিন পাইনা তোমায়,হয়না দেখা আর
তাই তো মনে ফন্দি আঁটি নিতে তোমার খোঁজ
উত্তরেতে ভরাই খাতা,দেখাই তোমায় রোজ
পড়াশোনার বাইরে কথা বলো না একদম
“হাতের লেখা বড়ই খারাপ, সাহিত্যবোধ কম”
সেদিন তুমি দেখছো খাতা,দাঁড়িয়ে তোমার কাছে,
একটি মেয়ে বললো এসে,” একটু কথা আছে,
থার্ড ইয়ারের ক্লাস হবে কি? আমরা নীচে আছি”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই, একটু দাঁড়াও ক্লাসের কাছাকাছি,
মিনিট পাঁচেক লাগবে সময় ” সুমন্তস্যার বলে।
একটু হেসে,চুল উড়িয়ে, মেয়েটি গেল চলে
বাংলা পড়ান অরুণ বাবু,একটুখানি কেশে
চোখ মটকে বলেন তিনি মুচকি হাসি হেসে
“থার্ড ইয়ারের সোনার মেয়ে,সুরঙ্গমা রায়
পড়াশোনায় তুখোড়,আবার খুব ভালো গান গায়
দেখতে পারো কথা বলে নতুন অধ্যাপক,
কথা বলা না হয় বিয়ের পিঁড়িতে শেষ হোক।”
“কি যে বলেন অরুণ বাবু” বললে লাজুক হেসে,
হঠাৎ যেন হিমেল হাওয়া ধরলো আমায় এসে
মাথার ভেতর নাগরদোলা, দিচ্ছে গায়ে কাঁটা
ফিরিয়ে দিলে খাতা আমার,বললে “চলি,টা টা।”
সুমন্ত স্যার বাংলা পড়াও থার্ড ইয়ারের ঘরে
আমিও তবে উঠি এবার, মন যে কেমন করে
নীচের ঘরে পড়াও তুমি, তাকিয়ে দেখি চেয়ে
তোমার দিকে অচল হয়ে তাকিয়ে সেই মেয়ে।
(৪)
সুরঙ্গমা রাজকুমারীর কোমর ছোঁওয়া চুল
দীঘল চোখে কাজল দিতে হয়না মেয়ের ভুল।
সবুজ শাড়ি মেরুন আঁচল ভুরুর মাঝে আলো
খোঁপায় লাগা রঙ্গনেতে লাগছিল খুব ভালো।
একুশ দুপুর ভরল মেয়ে ভাষার গানের সুরে
সামনে বসার পাইনি সুযোগ,দাঁড়িয়ে ছিলাম দূরে।
সুমন্ত স্যার দুচোখ বুজে বিভোর হয়ে ছিলে
গানের শেষে অবাক চোখে হাততালি খুব দিলে।
সংস্কৃতের তমালবাবুর দুষ্টু মুখের হাসি,
রজত স্যারের হাল্কা ঠ্যালা, শ্যামলবাবুর কাশি –
বুঝতে পারি সবই এখন, মেঘ করে তাই মনে
বেরিয়ে আসি বারান্দাতে,দাঁড়াই সিঁড়ির কোণে।
ঘড়ির কাঁটা পাঁচের ঘরে,ফিরবে এবার বাড়ি
বেরিয়ে এলে একটু পরেই,সঙ্গে সবুজ শাড়ি
মুখ ঘুরিয়ে নিলাম আমি, ঝাপসা চতুর্দিক
পা চালালাম বাড়ির দিকে,অরুণবাবুই ঠিক।
বসন্ত তার গান লিখে যায়, রুদ্রপলাশ ঝরে,
বইছে হাওয়া উত্তরেতে আমার মনের ঘরে।
(৫)
এখন তোমার সকাল বিকেল ভালোই কাটে বলো?
কলেজফেরত লুকিয়ে বুঝি একসাথে পথ চলো?
হাত ধরো রোজ শক্ত করে? নরম গলায় ডাকো?
ঝগড়া শেষে আদর খাওয়ার অপেক্ষাতেই থাকো?
সে বুঝি রোজ সকাল বিকেল গিন্নিপনা করে?
লোকাল ট্রেনে ভিড়ের মাঝে জাপটে তোমায় ধরে?
সে বুঝি খুব সহজ সরল,পাগল তোমায় নিয়ে?
তোমার ঠোঁটের ধোঁয়া ছাড়ায় মাথার দোহাই দিয়ে?
তাকিয়ে থাকো অবাক হয়ে? ডুব দাও ওই চুলে?
চোখ বুজিয়ে গান শোনো তার, সমস্ত কাজ ভুলে?
রাস্তাঘাটে তার আঙুলে আঙুল তোমার থাকে?
কালচে ঠোঁটের মায়ায় বুঝি দাও ডুবিয়ে তাকে?
দীঘল চোখের অতল জলে কেবল বুঝি ভাসো?
প্রহর শেষের আলোয় আজও তেমন করেই হাসো?
জানি ভালোবাসো,কেবল তাকেই ভালোবাসো।
(৬)
পলাশ শিমুল ফুটল, মুকুল ঝরল পথের পাশে,
লাগল ফাগুন শহর জুড়ে, হাওয়ায় আবীর ভাসে,
সন্ধ্যেবেলা জানলা খোলা, দখিন হাওয়ার গান,
আলতো চাঁদের আলোয় আমার লাগল প্রাণে টান।
একলা আমার আঁধার ঘরে ভুল সুরে গান গাই
গীতবিতান ছুঁয়েই এখন তোমার পরশ পাই
ডাইরি জুড়ে আবোলতাবোল দু চার কথা লেখা
দুপুরবেলায় খাতার পাতায় রঙিন তুলির রেখা
এসব দিয়েই তোমায় খুঁজি, তোমায় ছুঁতে পারি
টের পেয়ে যাই,চোখের দেখা আর নয় দরকারি।
খুঁজতে গিয়ে তোমায়,আমি নিজের কাছে আসি
নতুন করে নিজেকে রোজ চিনতে ভালোবাসি
দখিন হাওয়ার রাতে এখন চাঁদ আসে রোজ ঘরে
শুকনো পাতার বুকের ওপর আমের মুকুল ঝরে।
(৭)
আবীর,শাড়ি, হারমোনিয়াম,পলাশ-শিমুল জুটি
উৎসবে আজ মাতলো কলেজ,আজকে পড়ার ছুটি।
আজ আমাদের ফাগুন খেলা,কাল আমাদের দোল
নাচলো সবাই, গাইলো সবাই একসুরে “দ্বার খোল”
দরজা আমার খোলাই থাকে, আসবেনা কেউ আর
তবুও আমার আলোর দিকেই চোখ যায় বারবার
লাল রঙের ওই পাঞ্জাবিতে আলোর মতোই লাগে
ঢুকলে আমার সামনে দিয়েই,বসলে সবার আগে
অনুষ্ঠানের শেষের দিকে উঠল সুরঙ্গমা
গীটার হাতে দেবাংশুদা, ডাকলো তিলোত্তমা-
“তিন বছরের অমর জুটি,মানিয়েছে খুব ভালো,
ফরসা যেমন রাই কিশোরী, কেষ্ট ঠাকুর কালো”
গাইলো কি গান একটা দুটো, ঢুকলোনা আর কানে
ভাঙলো চমক হাততালিতে,”আসবো শেষের গানে”-
বললো ঘোষক,গাইলো সবাই “রাঙিয়ে দিয়ে যাও”
চুলের ফাঁকে আবীর লাগে, কাটছে না ঘোর তাও
সেলফি ওঠে যখন তখন,উল্লাসে ঘর ভরে
টুক করে আজ যাই পালিয়ে আবীর খেলার পরে
দাঁড়িয়ে থাকি মোড়ের মাথায়, চারটে বাজে সবে
আসতে তোমার খুব বড়জোর ঘণ্টাখানেক হবে
তিলোত্তমা ঠিক জানে কি? ইউনিয়নের মেয়ে,
সঠিক খবর জানতে পারে বাদ বাকিদের চেয়ে
আবোলতাবোল আকাশপাতাল চিন্তা মাথায় ঘোরে
দেখতে পেলাম আসছো তুমি আবীর তিলক পরে
দাড়ির ফাঁকে আবছা হলুদ,মাথায় সবুজ লেগে
থমকে গেলে সামনে আমার, উঠলো হাসি জেগে
পায়ের ওপর ছড়িয়ে দিলাম সমস্ত মন প্রাণ
দুঃখ সুখের আনন্দ আর অপেক্ষার এই গান
হাত ছোঁয়ালে মাথায়,তোমার হাত ছুঁলো দুই গালে
লুকিয়ে রাখা আবেগ আমার রইলো না আবডালে
চোখ দুটো খুব ঝাপসা হলো,বললে “ভালো থাকিস,
হারিয়ে কিছুই যায় না বোধহয়, যত্ন করেই রাখিস।”
চমকে যাওয়া থমকে গেছে, আলগা তোমার হাসি
বাস এসেছে তোমার, তুমি বললে,” এবার আসি।”
পাঠক,বোধহয় ভাবছো, এবার গল্প শুরু সবে?
ফাগুন বেলার নতুন খেলার পদ্য বলা হবে?
ভুল ভেবেছো বন্ধু আমার, দূর আকাশের আলো
যায় কি বাঁধা ইচ্ছে মতো? হয় কখনো ভালো?
তার আছে এক ভিন্ন জগত,অন্য চাওয়া পাওয়া
তার ঘরেতে দিনের শেষে নাই বা হলো যাওয়া
তাই বলে কি সব ফুরোলো? নষ্ট চোখের জল?
কক্ষনো না, এই যে এমন ভাবছি অনর্গল,
নিজের ভেতর তলিয়ে গিয়ে নিজের কাছেই আসা
অতল মনের নিবিড় আলোয় তোমায় ভালোবাসা
সেই তো আমার পরম পাওয়া,সেই যে তোমার দান
অপেক্ষাটাই সত্যি হলো, জাগলো আমার গান
বাস এসে যায়,চোখ চলে যায় পায়ের দিকে,দেখি
রাস্তা জুড়ে তোমার আমার ফাগুন মাখামাখি
এক ফাগুনের বুকের ওপর অন্য ফাগুন মেশে
জানলো বাসের প্রতীক্ষালয়,রাখলো ভালোবেসে।
প্রচ্ছদ : রাহুল সরকার
All rights reserved © Kothabriksha 2200