দোসর – চন্দ্রাণী গুপ্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

গ্রামের মেঠো পথ ধরে হেঁটে চলেছে গনি। দশ বছরের ছোট্ট একটা ছেলে গনি। প্রানোচছল, দুরন্ত। ইস্কুল ছুটির পর বাড়ির পথ ধরেছে। আজ ছুটির পর ‌বল পায়ে মাঠে থাকার কোনো আকর্ষণ নেই। তার প্রানের বন্ধু গণশা আজ ইস্কুলে আসে নি। গণশার বাড়িতে আজ এক ছোটখাটো উৎসব। গণেশ চতুর্থীর উৎসব। গণেশ ঠাকুরের পুজো। গণশার মুখে শুনেছে পাশের গ্রাম থেকে তার পিসিরা মাসীরা আসবে। সবাই পাতপেড়ে  ভোগ খাবে। গণশাও বেজায় বস্ত্ থাকবে। তাই গণশা  আজকে‌ ইস্কুল ছুট। গণশা কে ছাড়া  গণির এক মূহুর্ত চলে না। আম্মু তো আর বুঝলোনা। জোর করে ইস্কুলে পাঠিয়ে দিলো। তাই দেখে রাবেয়ার কি হাসি। রাবেয়া গণির ছোট বোন। গণশা ও গণি দু’জনেই রাবেয়া কে খুব ভালোবাসে। একটা ছোট্ট পুতুল পুতুল বোন। গণশা গতকাল ই তাকে বলেছিল  গণেশ পুজোয় তাদের বাড়িতে যেতে। কিন্তু গণি যেতে খুব একটা জোর ভরসা পাচ্ছে না। হিন্দু বাড়ির কোন পুজোতে গেলে সে কেমন সমাদর পাবে  তা নিয়ে সন্দেহ আছে তার।গণি , হোক না দশ বছরের  ছোট্ট একটা ছেলে। মাথায় সে যথেষ্ঠ পাকা। হিন্দু -মুসলমানের বিভেদ সে ভালোই বোঝে। কিন্তু গণশার সাথে তার বন্ধুত্ব টা তে কি করে নদীর জলের মতো মিলে গেল, তার সে কখনো বুঝতেই পারে না। গণশা তার প্রাণের দোসর। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, গণি আজ অবধি কখনো গণশার বাড়ির চৌহদ্দি মাড়ায়নি। ইস্কুলে — গ্রামের মাঠে — নদীর ধারে   গণশা, গণি আর রাবেয়ার মুক্তাঙ্গন।  নদীর ধারে একাকী বসে ছিল আমাদের গণি।বেশ খানিকক্ষণ কেটে যাবার পর এবার উঠতে যাবে। সহসা একটা চেনা, পরিচিত শব্দ।   সাইকেলের ক্রি্ন  শব্দ গণির মুখে  খেলে গেলো চওড়া হাসি।

গণশা সাইকেল চেপে আসছে। পেছনে বসে রাবেয়া। রাবেয়ার মুখে খুশির ছটা।– চইল্যা আয় গণি।গণশাকে দেখে গণির আনন্দ আর ধরে না। প্রাণের বন্ধু কে মনে হয় এক যুগ পর দেখল।এ টান তো রক্তের টানের চেয়ে বেশী বই কম নয়।  রাবেয়া আর গণশা যেন গণির হদয়ের দুটো অবিচ্ছেদ্য অংশ।

— কুথ্যে যাব । 

— আমগো ঘরে।

—- আইজ তো তোগো ঘরে পুজা আইছে না? উখানে গিয়া কি করুম?

— সেই লিইগাই তো তোগো নিয়া যাইতে আইছি।

গণির মন আনন্দে নেচে উঠল।পরমূহুর্তে গণশার অদেখা ঠাক্ মার কথা ভেবে সে পিছিয়ে আসল।

— কি হইল, চল।

—- তোর ঠাকমা যদি কিছু কয়? ডর লাগে।

— তোর চিন্তা নাই রে গণি। ঠাক্ মাই আইজ  কইল তোগো রে পুজায় আনত।

গণশাদের ছোট মাটির বাড়িটা আজ সুন্দর  ভাবে সেজে উঠেছে। নানা রঙের কাগজ দিয়ে বানানো হয়েছে রঙিন চাঁদোয়া। গণপতি কে যত্ন করে আসনে বসানো হয়েছে। ফুলে, ফলে গণপতি সেজে গুজে আলো করে বসে আছেন। খুবই সীমিত আয়োজন। কিন্তু আনন্দ ও ভক্তির কোনো খামতি নেই। গণশার সাইকেলের ঘন্টি র আওয়াজে ঠাক্ মা বেড়িয়ে এলো।গণি, অদেখা ঠাকমার সাথে এ ঠাকমার কোনো মিল খুঁজে পায়না। সত্যি কথা বলতে, খোঁজার চেষ্টা ও করে না। পরম মমতায় গণি ও রাবেয়া কে ঠাক্ মা  কাছে টেনে নিল। গণশার  সাথে কোনো তফাৎ করে না। গণি ঠাকমার মধ্যে তার হারিয়ে যাওয়া দাদিজানের  স্পর্শ খুঁজে পেল। দুই ভাই বোন মুক্ত ভাবে এক হিন্দু বাড়ির বাতাসে মন খুলে স্বাস নিতে পারল। এই শূড়ওয়ালা গণেশ ভগবানটাকে গণি ও রাবেয়ার খুব পছন্দ হয়ে যায়। খুব যেন বন্ধু-বন্ধু মনে হয়। খেলার দোসর লাগে। আকাশ থেকে নেমে যেন সোজা মাটির পৃথিবীতে মিলিয়ে যায়। পাশের বাড়ির বন্ধু টির মতো। সবচেয়ে বেশি মজা লাগে, তাদের নামে ও বডড মিল। গণি-গণশা-গণেশ। সবার সঙ্গে গণপতি র আরাধনায় অণশ নেয় গণি ও রাবেয়া। তার পায়ে ফুল ও বেলপাতা ছোঁয়ায়। পাতপেড়ে সবার সাথে ভোগ ও খায়।গণি ও গণশা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় । ধর্মের রক্তচক্ষুর কচকচানি সেখানে নেই। নেই ধর্মের দাম্ভিকতা। আছে চিরাচরিত শাশ্বত প্রেমের বানী। ধর্মের বিভেদ ভুলিয়ে , মানবতা কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া‌ – সেখানেই তো তার সার্থকতা।

প্রচ্ছদ: childhoodexplorer.com

লেখক পরিচিতি: লেখক পেশায় স্কুলশিক্ষক, অবসরে লিখতে ভালোবাসেন।

Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.