পাতা ঝরার বেলা – দেবমন্যু দাস

পাতা ঝরার মরশুম শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক সপ্তাহ আগেই। অক্টোবর এর গোড়ার দিক থেকেই প্রকৃতি যেন এই পাতা ঝরার আভাস দিচ্ছিলো। ইংল্যান্ড এ যা Autumn, বাংলা তে যা শরৎ আর শীত এর মাঝে লুকিয়ে থাকা হেমন্ত, সেই সময়টাকেই এই মার্কিন মুলুকে Fall বলা হয়। পাতা ঝরার থেকেই নাম হয়েছে Fall। এ দেশে আসার আগে অবশ্য এসব কিছুই জানতো না বলাই। গাছের ঝরা পাতার সঙ্গে যে ওর সখ্যতা হবে- তা কলকাতায় বড় হবার সময় কি ও ভেবেছিলো? শহরের কংক্রিট আর উঁচু উঁচু বাড়িগুলো এই বন্ধুদের কেড়ে নিয়েছিল ওর থেকে। কিন্তু এই দূর দেশে এসে বলাই নতুন করে চিনতে শিখেছে ওর বন্ধু এই গাছগুলি কে, ওদের এক একটা ডাল-পালা-ফুল-পাতাকে ভালোবাসতে শিখেছে নতুন করে। মরশুম এর শুরুর দিকে আবহাওয়া ভালো থাকলেই বলাই বেরিয়ে যেত ফটো তুলতে যাওয়ার জন্য, এই নেশাটা ওর ছোট বেলা থেকে, যদিও ভালো ক্যামেরা না থাকায় এতো বছর কোনো রকমে মোবাইল এর ক্যামেরাতেই ছবি তুলে সাধ মিটিয়েছে বলাই। byএবার গরম এর ছুটিতে একটা বেশ ভালো ক্যামেরা কিনেছে, সেই ক্যামেরা নিয়েই ম্যাসাচুসেট্স এর এই নর্থাম্পটন শহরের অলিতে গলিতে ঘুরে বেরিয়েছে ও, পাতা ঝরার এই মরশুম এর ছবি তুলবে বলে। প্রথম দিকে কয়েকটা গাছের পাতায় হলদে রং ধরেছিলো, দেখলে মনে হয় যেন পাতা গুলোর ন্যাবা হয়েছে। আরো এক সমগোত্রীয় গাছের দলের সাথে ও বন্ধুত্ব পাকিয়েছে। টকটকে লাল রঙের পাতাগুলো দেখলে মনে হয় ঠিক যেন রক্ত চন্দন মেখেছে ওরা। বেশ কিছু গাছের পাতা আবার ধূসর হয়ে উঠেছে। একটা ঝরা পাতার উপর আরেকটা পাতা যখন এসে পড়ে তখন বলাই সেই মুহূর্তগুলো ক্যামেরায় বন্দি করে। শীতল হাওয়ায় ভেসে আসা সেই শুকনো পাতা ধরবার জন্য বলাই ডান হাত তুলে লাফায়, যে পাতা গুলো ও ধরতে পারে সেগুলোকে বাড়িতে নিয়ে এসে জমিয়ে রাখে গীতবিতান এর পাতার মাঝখানে। 

নভেম্বরের শুরুতেই শীতের আভাস পাচ্ছিলো বলাই। এর মধ্যেই সপ্তাহ খানেক আগে একদিন প্রায় -৬ ডিগ্রী তে নেমে গিয়েছিল পারদ। সেদিনই মরশুম এর প্রথম বরফ পড়েছিল। প্রতিবারের মতো এবারও ঘরের বাইরে বেরিয়ে শীতের মরশুম কে আওহ্বান জানিয়েছিল নিজের কায়দায়। দু-হাত মেলে, আকাশের দিকে তাকিয়ে, সেই বরফ এর টুকরো আস্বাদন করেছিল ও। সেদিন রাতে আলো নেভানো ঘরে এসে সোফায় বসে বব ডিলান এর গান আর কাঁচের গ্লাসের তরলের ভিতর দিয়ে ও মরশুমের প্রথম বরফ পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় দেখেছিলো। আর কয়েক দিন পরই এই শহরের সমস্ত গাছ গুলো কেমন যেন ন্যাড়া হয়ে যাবে, এই লাল হলুদ সবুজের রঙের মেলা থেকে হঠাৎ করে কেমন করে সব কিছু রিক্ততায় ভরে উঠবে। শীত এর হাওয়া যেন যমদূতের মতো এসে এই সমস্ত পরিপূর্ণতা কে নিমেষের মধ্যে শূন্য করে দেবে- আবার কোন বসন্তের আগমনে সেই রিক্ততা পরিপূর্ণতায় ভরে উঠবে। 

“শূন্য করে ভরে দেওয়া যাহার খেলা,
তারই লাগি রইনু বসে সকল বেলা।”

– এ তো বলাই এর জানা, প্রতিবছরই অনুভব করে ও, তবু কেন যেন এবার শিউরে উঠেছিল অজান্তেই। 

ওর মনটা ভারী উদাস হয়ে গেলো, ভাবলো এই শেষের কয়েকটা দিন আর ক্যামেরার সাথে নয়, ও উপভোগ করবে প্রকৃতির এই অপরূপ ছবি একান্তে।

 তিন-চার দিন ঠান্ডার রেশটা রয়ে গেলো, তারপর আবার পারদ চড়তে শুরু করলো। একটানা মেঘলা আকাশ আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শেষে যেই দিন আকাশে ঝক ঝকে রোদ উঠলো, ও সেদিন বেরোলো হাতে সময় নিয়ে, প্রকৃতির সাথে সময় কাটাবে এবার। তখন বাজে দুপুর দুটো, সূর্যাস্ত হতে আরো দুঘন্টা মতো বাকি। 

রোজ বিকেলে ও বাইরে বেরোয় দৌড়োবার জন্য, ওদের বাড়ির পাশেই একটা সমাধিস্থল আছে, ওরই চার পাশে এক চক্কর দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসে।আজ ঠিক করলো দৌড়োবে না, সেই সমাধিস্থলে গিয়ে ঘন্টা খানেক কাটাবে নিজের সাথে, হাতে এক খানা বই নিলো – অমিত চৌধুরীর কলকাতা। প্রায় এক বছর হয়ে গেলো দেশে ফেরা হয় নি বলাই এর। এদেশে পিএইচডি সূত্রে আসার পর থেকে, প্রতি বারই বছরে দুবার করে ও কলকাতায় ফিরে আসে মাটির টানে- অন্তত প্রথম তিন বছর সেভাবেই কেটেছিল। এবছর Covid এর কারণে দেশে আসার পরিকল্পনা বানচাল হয়ে গেলো গরম এর ছুটিতে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ কলকাতার জন্য মন কেমন করছিলো ওর। যেদিন জাতীয় নির্বাচনের এর ফল প্রকাশ হলো, সেদিন আনন্দে বলাই আর ওর বিদেশী বন্ধুরা একে অপরকে বই উপহার দিয়েছিলো। এই নর্থাম্পটন শহরের এক ছোট্ট বই এর দোকান থেকে কলকাতার ওপর বই টা পেয়ে বেশ অবাক হয়েছিল, সেই বইটাই হাতে নিয়ে ও বের হলো সমাধিস্থলের উদ্দেশ্যে। 

ব্রিজ স্ট্রিট সেমেটারি- প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পুরোনো এই সমাধিস্থলে আগেও অনেক বার এসেছে বলাই, মাঝে মাঝেই ও হারিয়ে যায় পুরানো বিচিত্র সময়ে। ওর বিদেশী বন্ধুরা ওকে এই সমাধিস্থলের ইতিহাসের গল্প শোনায়, ও বাচ্চাদের মতো অবাক বিস্ময়ে শোনে সে সব কাহিনী। কত জায়গায় ছোট ছোট ঢিপি তৈরী হয়েছে এই সমাধিস্থলে। কোনো এক সময়ে, ভিন-জাতীয় (সম্ভবত আয়ারল্যান্ড’এর ) আর কৃষ্ণাঙ্গদের একই জায়গায় কবর দেওয়া হয়েছিল অর্থের অভাবে। একাধারে একই জায়গায় একাধিক বার কবর দেওয়ার ফলে প্রকৃতগত ভাবেই বেশ কয়েক জায়গায় গড়ে উঠেছে এই ঢিপি সমূহ। এই ঢিপিগুলো তে কোনো নাম ফলক নেই, নেই কোনো মার্কিন পতাকা। কেউ এসে যে ফুল দিয়ে যাবে, ইহলোক পারের পর সেই ভাগ্যটাও হয় নি এই ঢিপির বাসিন্দাগুলির। ঢিপির আরেক প্রান্তে যেই জায়গাটা সমতল, সেখানে কয়েক’শো স্মৃতিফলক আছে, অনেক ফলকের তো আকারও বেশ অদ্ভুত- গম্বুজ ধরণের, কোনোটা বা মন্দির এর মতো। পুরোনো নতুন হরেক রকমের নানা আকারের ফলক- এসব দেখলে বোঝা যায় কি পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়েছিল ওদের মৃত্যুর পর নাম রক্ষার্থে। এতো বছর পরও এখনও একই জায়গায় স্বমহিমায় টিকে আছে এরা এক রকম ভাবে। ও মাঝে মাঝেই সেই ফলক গুলোয় লেখা নাম আর সন-তারিখ দেখে। প্রচলিত নামের পরিবর্তন এর মধ্যে দিয়ে ও ইংরেজি ভাষার পরিবর্তন লক্ষ্য করে। কোনো কোনো ফলক গুলো তে আবার ধর্মীয় চিহ্ন দেখতে পায়, ক্রস এর মধ্যেও যে কত রকম এর কারুকার্য আছে, এবং ওদের যে নিজেস্ব ভিন্ন ভিন্ন মানেও আছে- তা কে জানতো? আর এই ফলক গুলোকে যেন সমান তালে লালন পালন করে চলেছে বলাই এর বন্ধুরা- বিশাল বড়ো বড়ো গাছ গুলো। কনিফার জাতীয় কিছু গাছ আছে, ওদের পাতা ঝরে না বিশেষ। কিন্তু এই গোরস্থানে ম্যাপেল প্রজাতীয় গাছএর সংখ্যারই আধিক্য, যেগুলোর ঝরা পাতা আজ এই সমাধিক্ষেত্রকে অপূর্ব রূপে সাজিয়েছে। শুকনো ঘাসের উপর ঝরে পড়া পাতাগুলো যেন একটা রংবাহারি খসখসে কার্পেট বিছিয়ে রেখেছে বলাই এর জন্য। 

সেরকমই এক ঢিপির সামনে এসে একটা গাছের তলায় সেই ঝরা পাতার কার্পেট এর উপর বসলো বলাই। দেখলো গাছটার গায়ে খোদাই করে লেখা পিটার ১৯৮৮। ইংরেজি অক্ষরে লেখা পিটার এর পদবিটা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। মাটি থেকে কয়েকটা শিকড়ও বেরিয়ে এসেছে। গায়ে একটা হালকা কার্ডিগান চাপিয়েছে ও আজ, বাইরে যথেষ্ট রোদ থাকলেও, একটা হিমেল হাওয়া আছে। চারিদিকটা একবার দেখে নিলো, না আজ আর কেউ আসে নি এখানে, মাঝে মাঝে দূরে দেখতে পাচ্ছে এক দুজন কে জগিং করতে, কেউ কেউ আবার পোষ্য গোল্ডেন রিট্রিভার নিয়ে হেটে চলেছে গোরস্থান সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে, তাছাড়া আর কোনো সাড়া শব্দ নেই এই তল্লাটে। এরকম নিস্তব্ধতা, নির্জনতায় বলাই নিজেকে যেন নতুন করে চেনে প্রত্যেক বার নতুন রূপে।

সমাধি ফলকগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো কত কথাই, মৃত্যুর পরও কোন অধিকারে এই পৃথিবীর বুকে এক খন্ড জমি কিনে রেখে যায় এই মানুষ? অধিকার কিভাবে মৃত্যুর পরও থেকে যায়? আর সেই অধিকারের সাথে আসে  বিভেদ! জীবনদশায় যেই বিভেদ থাকে, মৃত্যুর পর ও সেই বিভেদ রয়ে যায়। নাম না জানা সেই ঢিপি আর পাশের বড়ো গম্বুজ আকৃতির সমাধির দিকে চেয়ে ওর এসব কথাই মনে আসছিলো আজ। বইটা আর বেশি পড়া হলো না, খান তিরিশেক পাতা পড়বার পর, এসব ভাবনায় মগ্ন বলাই এর চোখ কখন যেন আস্তে আস্তে লেগে আসছিলো। হঠাৎ পাতার খসখসানিতে ওর তন্দ্রা গেলো ভেঙে, দেখলো দুটো কাঠবেড়ালি লম্ফ ঝম্প শুরু করেছে ঠিক ওর পাশেই। অদূরেই এক জায়গায় একটা ছোট ফলকের সামনে অনেকগুলো শুকনো পাতা জড়ো হয়েছিল, খেলা করার সময় এই পাতাগুলোকেই ছড়িযে ছিটিয়ে একাকার করেছে এই কাটুস কুটুস কাঠবেড়ালি দুটো। ওদের নাম ধরে মুখ দিয়ে নানা আওয়াজ করে ডাকলো বলাই, এতটুকু পাত্তাও পেলো না। অগত্যা নিজের কাজে ফিরতে হলো। আর বই পড়তে ইচ্ছে হলো না, বেলা পড়তে আর বেশি বাকিও নেই।  যে গাছটার তলায় ও বসে ছিল, এবার সেখানেই আলগা হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লো। গাছের পাতার ফাক দিয়ে দেখা যাচ্ছে নীল আকাশ, মেঘের এক খন্ডও নেই আজ আকাশে। দূরে কোথায় যেন দুটো বেনামি পাখি ডেকেই চলেছে কখন থেকে।একটু মন দিয়ে শুনলেই বোঝা যায় দুটো না, তিনটি ভিন্ন প্রজাতির পাখির আওয়াজ আসছে। একটাকে দেখতে ঠিক নীলকণ্ঠের মতো। আকারে একটু বড়ো – এই যা। লাল-সবুজ পাতার আড়াল দিয়ে মাঝে মাঝে রোদ এসে পড়ছে ওর চোখে। কলকাতায় থাকাকালীন শীতের দুপুরে মা এর সাথে বারান্দায় বসে ওরা একসাথে রোদ পোহাতো- সেই শীত এর রোদের সাথে আজকের হেমন্তের এই রোদের কোথায় যেন এক মিল খুঁজে পেলো। আজ ওর পরিবার এর থেকে বহু দূরে, এই সমাধিস্থলে ও যেন এক অনন্য পরিবার খুঁজে পেলো। ও আবার নিজেকে খুঁজে পেলো নতুন ভাবে। 

এবার যাওয়ার সময় হয়ে এলো, বইটা হাতে নিয়ে উঠতে যাবে- এমন সময় একটা পাতা কোথা থেকে উড়ে এসে পড়লো মুখের উপর, সদ্য বিচ্যুত পাঁচ-কোনার এই পাতাটার ডান দিকটা রক্তিম, বা দিকটা শুকনো সবুজ, মাঝে ছোট ছোট কালো ছোপ, এক দুটো জায়গায় ছিদ্রও দেখতে পেলো। রেখাগুলো কি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে! পাতাটাকে হাতে নিয়ে উল্টে পাল্টে কি জানি দেখতে লাগলো ও, ঝরে পড়া এই পাতাটার জন্য বলাই এর মন কেন জানি কেঁদে উঠলো। হেমন্তের এই শেষ বেলায় এসে আজ যাওয়ার আগে নিজের অজান্তেই গুন্ গুন্ করে গেয়ে উঠলো :

এই কথাটি মনে রেখো তোমাদের এই হাসিখেলায় 
আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়। 
শুকনো ঘাসে শূন্য বনে আপন মনে অনাদরে অবহেলায়, 
আমি যে গান গেয়েছিলেম জীর্ণ পাতা ঝরার বেলায়।  

ছবি: দেবমন্যু দাস

লেখক পরিচিতি: দেবমন্যু অর্থনীতির শিক্ষক এবং গবেষক, বর্তমানে University of Massachusetts এ গবেষণারত ও কর্মরত। পড়াশুনার পাশাপাশি সংগীত ও প্রকৃতি দেবমন্যুর বিশেষ বন্ধু।

Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.

2 Comments Add yours

  1. MRINMOY CHATTOPADHYAY says:

    সঙ্গীত প্রেমী প্রকৃৃৃৃৃৃতি প্রেমী আর একদিকে অর্থনীতির চর্চ্চা ও গবেষক নোয়েল , দেবমন্যু কে আমার অনেক শুভেচ্ছা ৷ ঈশ্বরের কাছে তোমার মঙ্গল কামনা করি ৷ দেখা হবে শীঘ্রই ৷

    Like

    1. Debamanyu Das says:

      Thank you Jethu! Khub bhalo laglo tumi je lekha ta porechho.

      Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.