টের পেতে হবে ! – নীলাদ্রি দাস – Kothabriksha

টের পেতে হবে ! – নীলাদ্রি দাস – Kothabriksha

বহুদিনের আড়ালে থাকা কোনো অতি পরিচিত প্রিয় কেউ হঠাৎ যদি আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে তাহলে অধিকাংশ সময় খুশি হই| অভিমান হয়ত থাকে কিন্তু কমবেশি খুশি হতে আমরা সকলেই চাই| তবে চাই কেন? বা শুধু খুশি হওয়া নয় কেন?

‘চাই’ শব্দটা উচ্চারণের সাথে যে যে বিষয়গুলি অতি কাছ থেকে জড়িত তা হল ‘দাবি’, ‘কোন বিপরীত পথের নিষেধ’, ‘কোন এক অপ্রতিরোধ্য অবস্থা’ ইত্যাদি|

এখন প্রশ্ন হল, এসব বলার অর্থ কি? যদি কোন কিছু প্রিয় না হয়! আবার, প্রিয় হলেই কি ‘চাই’ শব্দটা প্রযোজ্য হবে? অপ্রিয় কোন কিছু কোন না কোন ভাবে ‘চাওয়ার’ দাবিদার কি হতেই পারে না!!! অর্থাৎ, চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রটা সর্বদা প্রিয়-অপ্রিয়ের সাথে জড়িত| চাইতে তো অনেক কিছুই পারা যায় কিন্তু সাথে থাকে কতটুকু? তাই, কোনটা ‘শ্রেয়’ তার নিরিখে ‘প্রেয়’ হওয়া বাঞ্চনীয়| নচেত যেকোন ধরণের উপলব্ধির আস্বাদন সম্ভব নয় বা টের পাওয়া যাবে না| ‘টের’ না পেলে প্রিয়বস্তু অপ্রিয় হতে বেশি সময় নেবে না| এখন প্রশ্ন হল ‘টের পাওয়ার অর্থ কি’?

এই ‘টের’ পাওয়া হল একটা অদ্ভুত অনুভূতি অর্থাৎ নির্দিষ্ট বলে কিছু নেই, যখন হবে তখনই নির্দিষ্ট| জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয়স্থলেই হতে পারে কিন্তু কখন হবে তা নির্দিষ্ট নয়। এক্ষনে উদাহরণস্বরূপ কন্ঠমণিন্যায় প্রয়োগ করে বলা যেতে পারে – কোন এক ব্যক্তির গলায় হার থাকা সত্ত্বেও সে হারটি খুঁজে পাচ্ছে না| এমতাবস্থায় সে চারিদিকে হারটি খুঁজলেও অবশেষে গলায় হাত দিয়ে হার পাওয়ার উপলব্ধিটাই হল টের পাওয়া| তবে এই উপলব্ধিটা খুব তাৎক্ষনিক, যার হয় সেই বোঝে|

উপকরণের আধিক্য যাই হোক না কেন ‘টের’ পাওয়ার নিরিখেই বস্তু নির্বাচন হয়ে থাকে| যেমন ভাবে আমরা টের পাই কোনটা প্রিয় আর কোনটা অপ্রিয় বা তৎ অতিরিক্ত| অনেক সময় কোন বস্তুর প্রতি উপলব্ধি ভাষাতীত হয়ে থাকে যেমনভাবে খুব কাছের কাউকে বলি ‘আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি ভাষায় বোঝাতে পারবো না…তোমায় বুঝে নিতে হবে’| এখানেও সেই টের পাওয়া| নিত্যনৈমিত্তিক জীবনে প্রতিমুহুর্তে সাবধানে চলা, পাছে কারুর ক্ষতি না হয় অথবা অজান্তে ক্ষতি না হয়ে যায়| আমাদের জীবনের ‘টপ-বটম’ ও ‘বটম-টপ’ এর সাথে টের পাওয়া অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত| ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে সূর্যের উপস্থিতি টের পাওয়া থেকে ইন্দুর আগমনে রাত্রি আসন্ন পর্যন্ত| সম্পূর্ণ বিষয়টাই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের টের পাওয়ার উপর| বস্তুত যথা সময়ে টের পাওয়ার অর্থ হল সঠিক সময় বিষয়ের উপলব্ধি নয়ত তা নিয়ন্ত্রনের বাইরে অথবা অতি কাছে থেকেও কোন কিছু অনেক দূরে|

সামনের চলভাষের শব্দটা কতটা হার্জ-এ মস্তিষ্কে উদ্দীপনা তৈরি করবে তার দ্রুত টের পাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে শব্দের অনুভূতি ঠিক কি রকম বার্তা দেবে অর্থাৎ চলভাষটা কাছে না দূরে তা নির্বাচন করা সহজ হবে| আবার, চলভাষটির রিংটোন আস্তে করা না স্বাভাবিক অবস্থায় আছে তা স্থির হবে|

অন্যদিকে, এই রকম অতিমারির সময় আমাদের টের পাওয়ার উপর দাঁড়িয়ে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ| যে যত বেশি টের পাবে সে ততবেশি সাবধান হবে ও অপরকে সাবধান করবে|

খিদে পেলে খেতে হয়, ঘুম পেলে ঘুমোতে হয়, কথা বলতে ইচ্ছে হলে কথা বলি, গান গাইতে ইচ্ছে হলে গান গাই, ভালবাসার টের পেলে ভালোবাসি ও স্বপ্নের জগতে স্বপ্ন টের পাওয়া অর্থাৎ আমাদের অস্তিত্ব-র উপলব্ধি নির্ভর করছে এই টের পাওয়ার উপর নচেত জীবনে বেঁচে থাকার গুরুত্ত্বটাই অর্থহীন হয়ে যাবে|

এক্ষণে বাহ্যজগতের টের পাওয়ার সংক্ষিপ্ত পরিচয়ের পর আন্তঃজগতের টের পাওয়ার ক্ষেত্রটি আলোচনা করা যাক| প্রশ্ন হল, ব্যক্তি আমি ‘আমার আমি’ কে টের পাবে কি করে?

এখন দেখে নেওয়া যাক ‘আমি’ ও ‘আমার আমি’ –র মধ্যে পার্থক্য কোথায়? ‘আমি’ শব্দটা হল উত্তমপুরুষ একবচন (ইংরাজীতে ফার্স্ট পারসন) এবং ‘আমার’ (‘মম’ বা ‘মে’) হল ষষ্ঠী, সমন্ধ পদ, আমি অতিরিক্ত| যেমন – ‘আমার কলম’, ‘আমার বন্ধু’ এবং ‘আমার আমি’| ‘আমার’ পদটি ব্যবহৃত হয় আমি ও তৎসংযুক্ত কোন কিছুকে বোঝাতে| এখন কেউ বলতে পারেন, ‘আমি’ কি ও ‘আমার আমি’ কি?

‘আমি’ কি শুধু এই দেহমাত্র অথবা তৎঅতিরিক্ত কিছু বা ‘আমার’ মানে শুধুই কি আমার| এই সব সন্দেহের অবসান হবে যদি ‘আমি’-কে টের পাওয়া যায় এবং সাথে সাথে এটাও টের পাওয়া যাবে যে ‘আমি দেহ’ না বলে কেন বলা হয় ‘আমার দেহ’| কিন্তু কি ভাবে?

এই বিষয়ে ভারতীয়দর্শনে আলোচনা সুদীর্ঘকাল ধরে হয়ে আসছে ও হবেও কারণ, যতদিন এই মনুষ্যপ্রজাতি জীবিত থাকবে ততদিন পর্যন্ত এই জিজ্ঞাসা থাকবে| এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, জিজ্ঞাসা আসে কিঞ্চিত জানা ও অজানার মেলবন্ধনে| সম্পূর্ণ জানা ও অজানা থেকে প্রশ্ন আসে না অর্থাৎ কিছুটা এই ‘আমি’র টের সকলে পাই কমবেশি করে| প্রশ্ন, কি রকম?

খুব সহজ করে বললে যখন বলি ‘আমি খুশিতে আছি’ বা ‘আমি দুঃখ পেয়েছি’ ইত্যাদি| এই সুখ ও দুঃখের অনুভূতি কখনই কোন জড়দ্রব্য থেকে আগত নয় বা হতে পারে না| জড়জগত বলতে বস্তুর জগত যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব নেই| চেতনা যেখানে প্রাণ সেখানে| এটা টের পাওয়াই সুখ ও দুঃখানুভূতির প্রথম সোপান| কষ্ট পাওয়া মানে যেমন আমি আছি তেমনি সুখানুভুতিও আমির পরিচায়ক| এই সুখ ও দুঃখের আবর্তে জীবন অতিবাহিত হয়ে যায়| কিন্তু এই সব কিছুর উর্দ্ধে উঠে আনন্দকে উপলব্ধি করতে হবে কারণ আমরা ‘আনন্দস্বরুপ’| চেতনার উন্মেষের উপর দাঁড়িয়ে আমার ‘আমি’ কে টের পাওয়া|

চেতনা উন্মেষ-র অর্থরূপে বুঝতে হবে যেটা যা সেটাকে সেইরূপে জানা| অর্থাৎ বর্তমানে সকলের অতি প্রিয় চলভাষ হঠাত না চললে কষ্ট পাব না কারণ যন্ত্র-র বিনাশ আছে যেমনভাবে চেতনাহীন এই দেহ অন্তেষ্টির যোগ্য উপায় ভিন্ন ভিন্ন| তাই কোন প্রিয়ের প্রাণের বিয়োগ হলে কষ্ট হয়| যা প্রিয় তাই কষ্টের কারণ| টের পেতে হবে আসক্তির উৎসকে| তবেই উপলব্ধি হবে কোনটি চেতনাযুক্ত এবং কোনটি চেতনা বিহীন| এটাই শ্রেয়| যথার্থ অনুশীলন ও উপলব্ধি এই টের পেতে শেখায়| ভালোবাসা হোক সকলকে, ক্ষমা করা হোক সকলকে কিন্তু টের পেয়ে, বিনা বিচারে (যুক্তি) নয়|

যখন এই টের পেতে পেতে অমানিশার সূচীভেদ্য অন্ধকার কেটে যাবে, ভোরের ছোঁয়ায় মুক্ত হবে অজ্ঞানের আকাশ, মধুমালতির হিল্লোলে মিতালি হবে শুধু এই ‘আমি’ তখনই টের পাওয়া যাবে এই ‘আমি’ মানে সব (অভেদ) এবং ‘আমি’ মানে ব্রহ্ম|

নীলাদ্রি দাস: জে আর এফ , ভারতীয় দার্শনিক অনুসন্ধান পরিষদ, নিউ দিল্লী এবং গবেষক দর্শন বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.