রবিবার সকাল হলেই গিন্নি ব্যাগ ধরিয়ে দেন কর্তার হাতে। জব্বর বাজার করতেই হবে। সেদিনের মেনুতে কচি পাঁঠার ঝোল বা মুরগি হলে ও সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে পাতে পড়বে মাছ। এটাই বছরের পর বছরের কাহিনী প্রায় সব বাড়িতেই, থুড়ি প্রায় সব বাঙালি বাড়িতেই। মৎস-প্রিয় বাঙালি বাড়িতে বাজারটাও হয় পকেট বুঝে। মাসের প্রথমে ইলিশ, ভেটকি, চিতল, কই, পাবদা কিংবা গলদা বাজার থেকে কড়াই হয়ে সোজা পাতে পড়লেও মাসের শেষটায় পকেটে টান পড়ায় রুই কাতলা দিয়ে চালাতে হয়, তবুও মাছ কিন্তু চাইই। উৎসব অনুষ্ঠানের মরসুমে চড়চড়িয়ে মাছের দাম বাড়লেও আতিথেয়তায় মাছ বাদ দেওয়া চলে না। পার্শের ঝোল, চিতলের মুইঠ্যা, ভেটকির পাতুরি, ইলিশ ভাপা, তেল কই, সরষে পাবদা এসব নাম শুনলে বাঙালির জিভে জল আসবেই। এমনকি ঘটি বাঙালের দ্বন্দ্ব থাকলেও মৎস প্রীতিতে মিলটা কিন্তু রয়েই যায়।

আচ্ছা, ওই প্রবাদগুলো তো নিশ্চয়ই শুনেছেন?
কইমাছের প্রাণ, গভীর জলের মাছ, ভাজা মাছ উলটিয়ে খেতেও জানে না, ধরি মাছ না ছুঁই পানি – এমন সব প্রবাদেও কিন্তু বারবার ঘুরে ফিরে আসে মাছের কথা। এই যে এতক্ষণ মাছ-মাছ করছি তাহলে আসুন শুনে নিই সাহিত্যে মাছের পাকাপোক্ত জায়গাটা কেমন ছিলো, তার কথা।
কয়েক বছর আগে পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলায় গিয়েছিলাম পট উৎসব উপলক্ষে। পটচিত্রে ফুটে ওঠা মাছের বিয়ের একটা গান শোনালেন এক পটুয়া। গানটা ছিলো এরকম –
“দাঁড়িয়া মাছের বিয়ে করাতে চলো গো রঙিলা
পাবদা, ভেটকি বলছে দেখো,
তোমার হাতের চুড়ি হবো গো রঙিলা।”
লোকগানে এই মাছের প্রসঙ্গ মন কে নাড়া দেয়। তবে বাঙালির এই মৎস প্রীতি শুরু সেই প্রাকৃত পৈঙ্গলের সময় থেকে। সেখানে পাওয়া যায়,
“অগ্গরঅ ভত্ত রম্ভঅ পত্তা,
গাইকো ঘিত্তা দুগ্ধ সযুত্তা
মোইনি মচ্ছা নালিতা গচ্ছা,
দিজজই কান্তা খায় পুনরন্তা”….
কলাপাতায় গরম ভাত, গাওয়া ঘি, মৌরলা মাছের ঝোল এবং নলিতা(পাটশাক) যে স্ত্রী নিত্য পরিবেশন করতে পারেন তাঁর স্বামী পুন্যবান।

বৃহদ্ধর্মপুরাণে ও ব্রাহ্মণদের রুই মাছ ও পুঁটি মাছ খাওয়ার কথা বলা আছে। শিবায়ণ কাব্যে অলস শিবকে চাষাবাদে নিয়োজিত করতে না পেরে গৌরি বাগদিনীর ছদ্মবেশে শিবের ক্ষেতে মাছ ধরতে এসেছিলেন। তাই দক্ষিণ ২৪ পরগনার মৎসজীবী সম্প্রদায় আজ ও পুকুরের জল সেঁচে মাছ চাষ শুরু করার আগে মাকাল (মহাকাল) ঠাকুরের পুজো করে। ঝুমুর গানে ও উঠে এসেছে এক গ্রাম্যবধূর মাছ ধরার কথা,
“ডুব্যে ডুব্যে মাছ ধরি শুধাই পুঁটি টেংরা
অ ছট দেঅরা,
মালি ফুলে বইসল্য ভমরা।”
আবার টুসু গানে বলা হয়েছে, এক পরিবারের দীর্ঘদিনের অসুস্থতার পর আজ সে অন্নপথ্য গ্রহণ করবে, তাই শস্যোৎসবের দিন, শিশুটির জননী গান গাইছে,
“ছাড় ছাড় ডাক্তার বাবু,আমার রামে আজ ভাত খাবে।
কি কি করব তরকারী?
মুগ মুসুরি পটলভাজা মাগুর মাছের ঝোল করি।”
ভাদ্র সংক্রান্তিতে লাল মাটির দেশে ভাদু উৎসবের দিন মহিলারা সারিবদ্ধ হয়ে গান গায়,
“কাশীপুরের রাজার বিটি
বাগদী ঘরে কি কর?
কলসী কাঁখে লয়ে পরে
সুখ সাগরে মাছ ধর।”
উত্তরবঙ্গের রাজবংশীরা খাল বিল, নদীর মাছের উপর নির্ভরশীল। মাছ ধরা তাদের কাছে একটা উৎসব। সমবেতভাবে তাদের মাছ ধরাকে বলা হয় ‘বাহো মারা’। এই বাহো মারা কে ঘিরে ও আছে নানান গান। তার মধ্যে একটি হলো,
“মাছ মারে মাছুয়া ভাই রে ছেকিয়া ফেলায় পানি
হামার মাছুয়া মাছ মারিছে চন্দনা পরুয়া
মাছ মারে মাছুয়া ভাইরে ইলশা শামলং কইরা।”
বাংলা ছড়াতেও বাঙালির মৎসপ্রীতি লক্ষ্য করা যায়,
“খোকা গেল মাছ ধরতে ক্ষীর নদীর কূলে,
ছিপ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে,মাছ নিয়ে গেল চিলে”।
শৈশবে দুলে দুলে এই ছড়া আমরা প্রায় সকলেই তো পড়েছি, তাই না? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই জলের প্রাণীটিকে উপেক্ষা করতে পারেননি। সহজপাঠের পাতায় তিনি মাছ কে ঠাঁই দিয়ে লিখেছিলেন,
“বনে থাকে বাঘ,
গাছে থাকে পাখি,
জলে থাকে মাছ,
ডালে আছে ফল”…..
কিংবা সহজ পাঠের দ্বিতীয়ভাগে লিখেছিলেন,
“কাংলা, তোর ঝুড়িতে কী?
ঝুড়িতে আছে পালং শাক, পিড়িং শাক, ট্যাংরা মাছ, চিংড়ি মাছ। সংসার বাবুর মা চেয়েছেন”।
বাঙালির মাছ দিয়ে পেট পুরে ভাত খেয়ে ছুটির দিনে একটা দিবানিদ্রা চাই। “চিতল মাছের মুইঠ্যা, গরমভাতে দুইটা”এই কথাগুলো যেন বাঙালি জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। বাংলাকে বুকের ভিতর আগলে রাখতে তাই মৎস প্রিয় বাঙালি উদ্দাত কন্ঠে গেয়ে ওঠেন,
“বাংলা আমার সরষে ইলিশ চিংড়ি কচি লাউ,
বাংলা পার্শে মাছকে ধুয়ে জিরের বাটায় দাও”।

(ক্রমশ)
লেখক পরিচিতি :-
সুকন্যা দত্ত পেশায় একজন শিক্ষিকা। লেখালেখির পাশাপাশি বই পড়া ও ভ্রমণ হলো তাঁর নেশা।