ধূমকেতু নগরের বসন্তোৎসব – সজল দাস 

বছর দশেক আগে রিটায়ার্ড হওয়া উৎপল বাবুর এ বছর শখ হয়েছে যে, ধূমকেতু নগরে বসন্তোৎসবের আয়োজন করে বিশ্বভারতীকে টেক্কা দেবেন। বত্রিশ বছর শিক্ষকতা করে, এই সামান্য ইচ্ছাটুকু কি প্রকাশ করা যায় না? অনেক ভাবনাচিন্তা করে উৎপলবাবু এই সিদ্ধান্তে এলেন যে, ধূমকেতু নগরে এরকম ভাবে বসন্তোৎসব পালন করা বেশ কঠিন। আস্তে আস্তে সবাইকে দোল বা বসন্তোৎসবের মাহাত্ম্য সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। অনেক অনুরোধের পর উৎপলবাবুর স্ত্রী গীতা দেবী পেনশনের টাকা থেকে এক হাজার টাকা দিলেন, শুধু তাই নয় এই টাকা দিয়েই দোলের দিন মিষ্টি আর নাতনি তিন্নির জন্য রং কিনে আনতে হবে। পয়সা নষ্ট করা একেবারেই চলবে না। অগত্যা উৎপলবাবু সাতশো টাকা দিয়ে ‘ধামাকা’ সাউন্ড অ্যান্ড ইলেকট্রিক থেকে একটা বেশ বড়ো সাউন্ড বক্স আর মেশিন ভাড়া করে আনলেন। এবার দোলের দিন সকাল থেকে রবীন্দ্র সংগীত বাজবে, এটাই প্রথম বছরের বসন্তোৎসবের জন্য যথেষ্ট।

‘ধামাকা’ সাউন্ড অ্যান্ড ইলেকট্রিকের মালিক নন্দলালদা দোলের আগের দিন সন্ধ্যায় একটা ভ্যানে করে সেগুলো দিয়ে গেল। আপাতত সেগুলো উৎপলবাবু তার বাড়ির পিছনের ঘরে রাখলেন। ঐ ঘরে থাকে ভূজঙ্গবিহারী দাস। বাঙালির ছেলে হলেও সবাই বিহারী বলেই ডাকে। একটা কোম্পানিতে নাইট গার্ডের কাজ করতো ভূজঙ্গবিহারী, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ার রোগের জন্য চাকরি গেছে। এখন বিহারী এই ধূমকেতু নগরে নাইটগার্ড কাম উৎপলবাবুর বডিগার্ড। উৎপলবাবুর বাড়ির অনেক কাজও করে দেয় বিহারী, তার বিনিময়ে গীতা দেবী থাকতে দিয়েছেন। এদিকে উৎপলবাবু তো আনন্দে নাচছেন, সাউন্ড চেক হয়ে গেছে। গুরুদেবের গান সারা পাড়াতে ছড়িয়ে যাবে, বসন্ত এসেছে মনে মনে। 

অন্যদিকে ন্যাড়াপোড়া হওয়ার পর বিটকেল,  ছোটকা, পাপ্পু আর গনেশ এসে হাজির উৎপলবাবুর বাড়িতে আয়োজন দেখতে। উৎপলবাবু তাদের বললেন নিজের পরিকল্পনার কথা, সকলেই উৎপলবাবুর অনেক প্রশংসা করলেন। ছোটকাদা তো গদগদ হয়ে প্রণাম করে বললো “দারুণ আইডিয়া দাদু, আমরা আছি তোমার সাথে”।

আজ দোল। সকাল সাড়ে সাতটায় উৎপলবাবু উঠে দেখলেন যে ঘরে ভূজঙ্গবিহারী নেই। কিন্তু বাকি সবই আছে। কিন্তু ভূজঙ্গবিহারী নাহলে কে এই ভারী সাউন্ডবক্স নিয়ে উঠোনে রাখবে কে?

পাপ্পু ক্লাস ইলেভেন অবধি পড়াশোনা করেছে, এখন রংয়ের কাজ করে। বিয়ের বয়স হলেও বিয়ে হয়নি, মেয়েরা পাপ্পুর মনটাকে না বুঝে শুধুমাত্র গুটখা খাওয়া দাঁত দেখেই কেটে পরে। সেই পাপ্পুদা আজ একটা সাদা পাঞ্জাবি আর পাজামা পরেছে, যদিও ছোট সাইজের, গলায় জং ধরা একটা চেন। ঘুন্টে রং মাখতে এলে পাপ্পু বললো,- “জানিস না আমার ইস্কিনে পবলেম?” পাপ্পুর আসল উদ্দেশ্য উৎপলবাবুর বসন্তোৎসবে যোগ দিয়ে, বাসব বিশ্বাসকে ইমপ্রেস করা। কেন ? আরে বাসববাবু পাড়ার নতুন ভাড়াটে, বাসববাবুর মেয়ে রিমার প্রেমে পাগল পাপ্পু। রিমা দেখা হলেই মুচকি হাসে যে। তাই এই বসন্তোৎসবে বাসববাবুকে ইমপ্রেস করতেই হবে।

সকাল ন’টার সময়ও ভূজঙ্গবিহারীর দেখা না পেয়ে উৎপলবাবু চিন্তায় পড়ে গেলেন। এমন সময় ছোটকা আর বিটকেল এসে হাজির। উৎপলবাবু গদগদ হয়ে বললেন যে, সাউন্ডবক্সটা উঠোনে এনে রাখতে। ওরা সেই কথা মত সাউন্ডবক্স উঠোনে আনার পরেই আবার এক নতুন বিপত্তি, সাউন্ডবক্স তো কিছুতেই বাজছে না। বিটকেল আর ছোটকা অনেক চেষ্টা করছে। উৎপলবাবুর মাথায় হাত।

তখন বিটকেল আর ছোটকা বললো আপনি কোনো চিন্তা করবেন না দাদু, আমি নন্দলালদার দোকানে নিয়ে গিয়ে বদলে আনছি, শুধু ভ্যান ভাড়াটা দিন। উৎপলবাবু কান্না চেপে একশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলেন।

ঐ দিকে পাপ্পুর প্রাণ বেড়িয়ে যাচ্ছে, রাস্তা ছেড়ে ঘরে বসে আছে, উৎপলবাবুর বাড়িতে বসন্তোৎসব শুরু হলেই সে যাবে। এগারোটা প্রায় বাজে, পাপ্পু আর অপেক্ষা করতে না পেরে, বেরিয়ে পড়লো রাস্তায়। উৎপলবাবুর বাড়ি যাওয়ার পথেই বাসব বিশ্বাসের ভাড়া বাড়ি। নতুন করে বাড়ি বানাচ্ছে, তাই ধূমকেতু নগরে ভাড়া বাড়িতে আছেন। বাসববাবু বেশ দামি হুইস্কি দু’পাত্তর চাপিয়ে, উৎপলবাবুর বাড়ি যাবেন বলে সবে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছেন, অমনি পাপ্পু তার পায়ে আবির দিয়ে প্রণাম করে ফেলল। বাসববাবু একটু চমকে গেলেও হাসিমুখে বললেন “বেঁচে থাকো বাবা”। এই বাঁচার ইচ্ছা মারাত্মক, মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। পাপ্পুর সেটাই হলো, রংমিস্তিরি পাপ্পু হুট করে বলে ফেলে “বৌদি আর রিমা কোথায়, ওদেরও কয়েক পোঁচ লাগিয়ে যাই”। রংমিস্তিরি পাপ্পু ভুল করে তার লাইনের অভ্যাস মতো কথা বলে ফেলেছে, ভুলটা বুঝতে পারার আগেই বাসববাবু পাপ্পুর বুকে লাথি মেরে দিয়েছে, তারপর মুগুর ছাপ জুতোকে মুগুরের মতো ব্যবহার করে বাসববাবু। পাপ্পু ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ পেলনা। হবু শ্বশুর জুতোপেটা করে ছাড়লো। রিমার ভাই রনি এসে ভিডিও তুলতে তুলতে বললো “বাপি, আরও মারো, পুরো ভাইরাল কেস, আমি ফেমাস হয়ে যাব”। বাসববাবু বেশ কিছুক্ষণ পিটিয়ে ক্লান্ত হয়ে, ঘরে ঢুকে গেল। পাপ্পুর চিৎকার কেউ শুনতে পেলনা, ধূমকেতু সংঘে তখন খুব জোরে “রং বরষে” বাজছে। বারোটা নাগাদ ধূমকেতু নগরের অনেকেই হালকা হারিয়ে গেছে। ক্লাবের ছোট মাঠে এক-দেড়শো লোক নাচছে কিংবা হামাগুড়ি দিচ্ছে। কেই দুটোই করছে, মানে নাচও করছে হামাগুড়িও দিচ্ছে।

উৎপলবাবু বারান্দার গ্রিল ধরে ছলছল চোখে দাড়িয়ে আছেন। ক্লাবের হৈ চৈ, নাচ আর চটকদার গান তার বসন্তোৎসবের পিন্ডি চটকে দিয়েছে। হঠাৎ করে কী একটা ভেবে, উৎপলবাবু দৌড় দিলেন ধূমকেতু সংঘের  দিকে। তখন টুম্পা সোনার তালে নাচ চলছে। নাইটি পরা মেয়েদের ভিড়ের পাশে সাউন্ডবক্সের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন উৎপলবাবু। তারই ভাড়া করা সাউন্ডবক্সে রবীন্দ্রসংগীত না বেজে টুম্পা সোনা বাজছে ! এ সব ছোটকা আর বিটকেলের কারসাজি। উৎপলবাবু আরও দেখলেন ক্লাবের ঘরে রাখা তক্তপোশের উপর ভূজঙ্গবিহারী হা করে ঘুমোচ্ছে, তার পাশে রাখা দেশি মদের বোতল ।

বিটকেল কেলো বুঝে হামাগুড়ি দিতে দিতেই কোথায় পালাল। উৎপলবাবু সাউন্ডবক্স বন্ধ করে প্রতিবাদ করবেন তার আগেই রোশনি দিদি এসে জড়িয়ে ধরে বললো “দাদু আই লাভ ইউ, সাউন্ডবক্সটা দেওয়ার জন্য”, বলেই অন্য  মেয়েদের ডেকে উৎপলবাবুকে রং মাখিয়ে ভুত করে দিল। হাতা ছেঁড়া পাঞ্জাবী নিয়েও এগিয়ে যেতে গিয়ে থেমে গেল উৎপলবাবু। ছোটকা এসে রাস্তা আটকালো, নেশায় চুর ছোটকা উৎপলবাবুকে জড়িয়ে ধরে শুধু বললো, “টুম্পা সোনা একশো টাকার জন্য এরকম করতে নেই, হালকা মুডে নাচ শুরু করো”। উৎপলবাবু তবে রে বলে চড় মারতে গিয়েও থেমে গেলেন। ছোটলোকের দল, অশিক্ষিত, জানোয়ার বলতে বলতে বাড়ি যাচ্ছেন, এমন সময় পাড়ার কুকুরগুলোও ডেকে যাচ্ছে উৎপলবাবুর দিকে তাকিয়ে। সেই ডাকেও উৎপলবাবুর ব্যঙ্গ বোধ হলো। রংমাখা দাদুর অবস্থা দেখে তিন্নিও বাপরে বাপ বলে দোতলাতে পালালো। ছোটকা আর বিটকেল ধূমকেতু সংঘের কার্যকর্তা। সাউন্ডবক্স ভাড়ার টাকা দিয়ে মদ কিনেছে, পরিকল্পনা মতো। ভূজঙ্গবিহারীকে হাত করা এমন কিছু না, দেশি মদের লোভে ও ছোটকা আর বিটকেলের দলে যোগ দিয়েছে। ওর পাওনা দেশি মদের দামটাও উৎপলবাবুর থেকেই আদায় করেছে ওরা। তিনটে নাগাদ একটা পুলিশের গাড়ি নিয়ম মতো টহল দিয়ে গেছে।

এত কিছুর মধ্যে পাপ্পুর দেখা নেই। জুতোপেটা খেয়ে পাপ্পুকে শেষ দেখা গিয়েছিল শম্ভুর গ্যারেজে, ওখানে সবাই রং নয় পোড়া মোবিল মুখে মেখেছে। পাঁচটা নাগাদ পাপ্পুকে দেখা গেল ধূমকেতু সংঘের মাঠের পাশে, গাছতলায় পড়ে আছে। গায়ের পাঞ্জাবীটা নেই, ঐ রকম অনেকের জামা, গেঞ্জি বেঁধে টানানো হয়েছে রাস্তায়। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো পাপ্পুর পাজামাটার একটা পা কোমর অবধি নেই, কেউ ছিঁড়ে দিয়েছে। সেই অংশটাও ঝুলছে পোস্টের সাথে। নানা রকমের রং আর পোড়া মোবিলের মধ্য দিয়ে জুতোর দাগগুলো বোঝা যাচ্ছে না।

লেখক পরিচিতি : সজল দাস কলকাতার দক্ষিণ বেহালার বাসিন্দা। পেশায় চাকুরিজীবী। চাকরির পাশাপাশি শিক্ষকতা, ক্যুইজ, ছবি তোলা, বাগান করা তাঁর সখ।

Copyright © Kothabriksha 2021, All Rights Reserved

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.