প্রিয় শঙ্খবাবু,
আপনাকে চিঠি লিখতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছে পিছন দিক থেকে শুরু করি। ইতি দিয়ে শুরু করি। শেষ থেকে তরতর করে উঠে যাই উপরে। দেখি না, পৌঁছোতে পারি কিনা, আপনার থেকে শেখা একাকী প্রবহণকে স্পর্শ করার পাঠ কাজে লাগাতে পারি কিনা; কারণ ততক্ষণে ‘সমস্ত আঘাত/পালকের মতো এসে বুকের ওপরে হাত রাখে’।

আপনার হয়তো মনে নেই, আপনি আমার এক ভাইকে অন্নপ্রাশনে আশীর্বাদ করেছিলেন। এটা শোনার পর সেকি হিংসে আমার। আপনি আশীর্বাদ করেছেন যখন ওর জীবনে কবিতা অবশ্যম্ভাবী। আমি ভাবলাম তাহলে কি আমার কবিতা হবে না? আমার ভাইয়ের বাবা, আপনার কবিবন্ধু, হেসে বলেছিলেন, যারা মন দিয়ে কবিতা লেখে, তাদেরকে শঙ্খ ঘোষ দূর থেকে আশীর্বাদ করেন। কিন্তু যেখানে কবিতা হতে পারে না, হওয়া সম্ভব নয়, সেখানেও কি করে এমন নির্দ্বিধায় ফলালেন কবিতার সনাতন নিমগাছ? – ‘তুমি বললে মানবতা/আমি বললে পাপ/বন্ধ করে দিয়েছে দেশ/সমস্ত তার ঝাঁপ/তুমি বললে হিটলারিও জনপ্রেমে ভরা/আমি বললে গজদন্ত/তুমি বললে ছড়া।’ ছায়া। কেবল ছায়া দীর্ঘকায়। আচ্ছা, ভয় করল না একটুও? আপনি এই কবিতার অনেক আগেই লিখেছিলেন ‘বন্ধুরা মাতি তরজায়’- এর কিছু কবিতা। এত প্রতিস্পর্ধার কলম পেলেন কোথায়? এই বইয়েরই ‘রাধাচূড়া’- যেমন প্রতীকী, ‘জ্যাম’-তেমনি প্রত্যক্ষ। এত এত বদলে যাওয়া, এত এত পাল্টানো? এত এত হাহাকার, এত এত তর্জনী? কিন্তু আপনার স্বর নিচুগ্রামের। আপনার স্বর উচ্চকিত নয়। আপনার স্বর রুচির পরাকোষ্ঠা। আপনার প্রতিবাদ সহজে দেখানো, জোর করে নয়। যদিও আইরনি এখানেই – সহজ কথাও ততটা সহজ নয় – এ তো আপনারই শেখানো। আচ্ছা, কি করে বুঝলেন এই বন্ধুর পথে কিভাবে হাঁটতে হবে? যদি শিলাবৃষ্টি হয়? যদি খসে পড়ি, তলিয়ে যাই, নীচে? মহাগভীরে? আপনি হাতটা ধরবেন তো?

আমি আপনার থেকেই জেনেছিলাম, যাপনই কবিতা – ‘জীবনযাপনে আজ যত ক্লান্তি থাক/বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।’ কিন্তু মাঝে মাঝেই ভয় হয় যখন জীবন স্তব্ধতায় উপচে পড়ে। এই জরাগ্রস্ত ফাল্গুনে, বৈশাখে, আশ্বিনে। এই থেমে থাকার, থামিয়ে দেওয়ার সময়ে।ঠিক তখনই মনে পড়ে আপনি লিখেছিলেন- ‘আবার সুখের মাঠ জলভরা/আবার দু:খের ধান ভরে যায়/এমন বৃষ্টির দিন মনে পড়ে/আমার জন্মের কোনো শেষ নেই।’ আমি বৃষ্টিতে ভেসে যাই। ভালোত্বের বাসা, ভালোবাসার ঠিকানাও যায় ভেসে। ‘যেন এই পৃথিবীতে কেউ কোনোদিন/প্রেম বলে কোনো ঋণ রাখেনি কোথাও’। রাখতে শিখলাম কি? যেমন বোধকরি শিখিনি, বলতে,’তোমার কোনো ধর্ম নেই, শুধু/শিকড় দিয়ে আঁকড়ে ধরা ছাড়া..’ এই চরমপন্থী মেরুকরণের সময়ে, আমরা তো অনেকেই রাস্তায় নামলাম। কত কি চিৎকার করে বলা হল। আপনার মত করে পারলাম কই? পঠন – পাঠন তুলে দিয়ে, কেবল মনে হয়: ‘একটি কথা কখনো বলব না ভেবেছি আদি থেকে/বন্ধুরা তবুও বারেবারে/টেনে নিতে চায় সেই অমোঘ বর্ণেরই দিকে, বলে: সময় কি হয়নি জানার?’ আচ্ছা বন্ধুরা বলতে কি আপনি আপনার সমসাময়িক কবি-বন্ধুদের কথা বললেন? যারা হয় রোমান্টিক নয়তো মোটা দাগের রাজনৈতিক উচ্চারণ করেছেন কেবল? কিন্তু তাদের থেকে তফাতে দাঁড়ালেন আপনি। শিরদাঁড়া উন্নত, চাহনি স্পষ্ট। এই তফাতই কি এনে দিল আপনার নিবিড়তম আত্মবীক্ষণ? কি জানি মনে হয় কবিতায় আপনার দেখাটাও ঠিক দেখা নয়- বুঝি আরো কিছু- ‘অল্প দু-চারজন বাকি থাকে যারা/তেল দেয় নিজের চরকায়/মাঝে মাঝে খড়খড়ি তুলে দেখে নেয়/বিপ্লব এসেছে কতদূর..’
আঠারো বছর বয়স থেকেই ঠিকানা পাল্টাতে পাল্টাতে মনেই পড়ে না আমার বাসার বাসনার কথা- ‘যা কিছু আমার চার পাশে ছিল/নির্বাসন/কথামালা/একলা সূর্যাস্ত/যা কিছু আমার চার পাশে ছিল/ধ্বংস/তীরবল্লম/ভিটেমাটি/সমস্ত একসঙ্গে কেঁপে ওঠে পশ্চিম মুখে/স্মৃতি যেন দীর্ঘযাত্রী দলদঙ্গল/ভাঙা বাক্স প’ড়ে থাকে আমগাছের ছায়ায়/এক পা ছেড়ে অন্য পায়ে হঠাৎ সব বাস্তুহীন।’ কিন্তু প্রিয় বন্ধু মনে করিয়ে দেয় একটা জিনিস পাল্টায়নি তো, রয়েছে তো! আপনি। আমি আপনার কবিতার বইগুলি সঙ্গে নিয়ে সেই যে এলাম বিদেশে আর তো ফেরা হল না তাদের। তারা আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে, খায়। আর আর ফিরে ফিরে বলে, ‘তুমিই এখন আমি, আমিই তুমি।’

এত কথা বলতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করা হল না, আপনি কেমন আছেন। আশা করি লিখছেন। আমার কথা। আমাদের কথা। সেই প্রবাহদুয়ারপারে। যেখানে ‘মেয়ে হয়ে আজ দাড়িয়ে রয়েছে সমস্ত গাছগুলি’, সেইখানে।
আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম জানবেন,
শ্রেয়স সরকার।
লেখক পরিচিতি : শ্রেয়স সরকার একজন ভারতীয় বাঙালি কবি, শিল্পী ও মাইক্রো ইলেক্ট্রনিক্স বিদ্যার গবেষক। ইংরেজি কবিতায় তার সুপ্রশংসিত কাজের জন্য তিনি একাধিক সাহিত্য ও শিল্প পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন ও তার লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়েছে বহু আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকায়। নবীণতম বহুবিদ্যাজ্ঞ হিসেবে, তার কথা ‘এডুকেশন-ওয়ার্ল্ড’ ও ‘ল্য মরিসিয়ান’ নামক ফরাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি প্রখ্যাত পিয়ানোশিল্পী ভ্যালেন্টিনা ইগোশিনার সঙ্গে কাজ করেছেন, শোপাঁ কে নিয়ে। বহু প্রদশর্নীতে তার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে এবং সম্প্রতি শিকাগো ইনন্সিটিউট অব আর্টে তার চিত্রকর্ম পুরস্কৃত হয়। এ ছাড়া তিনি নানান রন্ধনকর্ম ও বিরল ভারতীয় পুঁথির ভাষাতাত্ত্বিক কাজ করে আনন্দ পান। তিনি কলকাতা ও প্যারিসের মধ্যে সময় ভাগ করে নেন, যেখানে তিনি বর্তমানে গবেষণারত।
Copyright © Kothabriksha 2021, All Rights Reserved.
আত্ম উন্মোচন
LikeLike