রবীন্দ্রনাথ – তাঁর চিঠি, তাঁকে লেখা চিঠি – মধুমিতা বসু

কবিপক্ষ শব্দটা যাঁর জন্য উৎপত্তি তিনিই কবিগুরু।

কেন জানি না, বৈশাখ মাসটা এলেই আমার মনটা ভাল হয়ে যায়। পঁচিশে বৈশাখ। প্রতিবছরই আসে নিয়ম করে। এবছরও তার অন্যথা নেই। কিন্তু কত কিছুই না উলট পালট হয়ে গেল এই দু বছরে সারা বিশ্ব জুড়ে। তবু তারি মধ্যে মনের স্থিতি ধরে রাখার চেষ্টা তো করতেই হয়। কত কিছুই না ভাবছি। ভাবি, হঠাত যদি কারও একটা চিঠি আসত এখন? কিন্তু তারপরই বুঝি ভাবনাটি অবাস্তব। এখনকার ডিজিটাল মিডিয়ার যুগে চিঠির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে।  কম্পিউটারের কি-বোর্ডে একটি বোতামের চাপেই ই-মেল নিমেষের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে, কোন অতিরিক্ত খরচ ছাড়াই। এখন অভ্যেসহয়ে গেছে এতেই অথচ ছোটবেলায় মনে পড়ে ডাকপিওন বাড়িতে চিঠি দিয়ে গেলে সে কি উন্মাদনা! কার চিঠি, কে লিখল সেই নিয়ে মাতামাতি। অনেকের মত আমারও এই নতুন অভ্যেস মানিয়ে নিতে যে অসুবিধা হয়নি তা নয় তবে কালের নিয়মে সয়ে গেছে তা ক্রমে ক্রমে। তার আরেকটা প্রধান কারণ হল জীবনের সব সমস্যার সমাধানই যে আমি খুঁজে একজনের কাছ থেকে, তাঁর সৃষ্টিতে, তিনি রবীন্দ্রনাথ।

লেখার অভ্যেস খুব একটা নেই বললেই চলে। এতগুলো বছর ধরে শুধু কথা বলারই অভ্যেস হয়েছে। তবু চেষ্টা করতে মন্দ কি?

চিঠি আসে আবার চিঠি যায়ও। একশ বছর আগের চিঠির মূল্য যে অপরিসীম তা তো অনস্বীকার্য। আসলে চিঠি হল সেই সময়ের দলিল। মনে হয় যেন জীবন যাপনের একটি সুন্দর তথ্যচিত্র। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোধহয় অগ্রণী সর্ব বিষয়ে। এক্ষেত্রেও তাই। তাঁর কয়েকটি চিঠির নমুনা প্রকাশ করেই নিজের ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ করব।

চিঠি প্রসঙ্গে কবি বলেছেন, “যেমন বজ্র পড়ে গেলে তবে তার আওয়াজ পাওয়া যায়, তেমনি পরস্পর দূরে থাকলে যথা সময়ে আওয়াজ পাওয়ার জো নেই। ঘটনা নিঃশ্বেষ হয়ে গেলে পর তখন তা আলোচনা করতে হয়।“  সত্যিই তো, মেয়েকে মা যখন চিঠিতে লেখেন- জানিস তো এ বাড়িতে তোর লাগিয়ে যাওয়া কামিনী গাছটায় ফুল ফুটেছে… আহা, ভালবাসা ও নিসর্গ যেন হাত ধরাধরি করে চলতে শিখল।

কবিগুরুর চিঠির কথা আমরা তো জানি, কিন্তু সাধারণ –অসাধারণ কিছু মানুষ তাঁকে চিঠি লিখেছেন তা পড়তেও বেশ মজা লাগে, জানাও যায় অনেক কিছু।

শ্রীমতি সুধারানী সেন ভিক্টোরিয়া কলেজের বাংলার শিক্ষকের স্ত্রী তাঁর চিঠিতে প্রথমে অনুযোগ করে লিখেছিলেন যে – 
“আমার চিঠির উত্তরে আপনি শুধু আশীর্বাণী পাঠিয়েছেন আর আমার বোনের চিঠির উত্তরে আপনি কবিতা লিখে পাঠিয়েছেন – আমি খুবই রাগ করেছি।”
তারপরেই তিনি জানতে চান ‘জনগণমন অধিনায়ক’ গানের ‘অধিনায়ক’ এবং ‘ভারতভাগ্যবিধাতা’ বলতে কবি কোনও ব্যক্তিকে বুঝিয়েছেন কিনা, কিংবা পঞ্চম জর্জ বা অপর কোন রাজার উদ্দেশ্যে লিখেছেন কিনা।
কবি তার উত্তরে লিখেছেন –
“তুমি যে প্রশ্ন করেছ, এমন অদ্ভুত প্রশ্ন পূর্বেও শুনেছি
পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা
যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী
হে চিরসারথী তব রথচক্রে
মুখরিত কত দিনরাত্রি।
শ্বাশত মানব ইতিহাসে যুগে যুগে ধাবিত পথিকদের রথযাত্রায় চিরসাথী বলে আমি চতুর্থ জর্জের স্তব করতে পারি এরকম অপরিমিত মূঢ়তা আমার সমন্ধে যারা সন্দেহ করতে পারেন তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অবমাননা।”
ইতি
২৯/৩/২৯
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অন্তরের অন্তস্থল বলে একটি বিষয় আছে, চিঠি পড়ে যেই ভাবটি বুঝতে কোনই অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

মনে পড়ে সেইবার শিলাইদহে গিয়েছি। কবির বাড়িতে পৌঁছে সেই বোটটি দেখলাম আর কত কিছু মনের মধ্যে ভিড় করে আসতে লাগলো।
মনে পড়ে গেল কবি তাঁর ছিন্নপত্রাবলীতে লিখেছেন –
“স্রোতের অনুকূলে বোট চলেছে তার ওপর পাল পেয়েছে। দুপুর বেলাকার রোদ্দুরে শীতের দিনটা ঈষৎ তেতে উঠেছে। পদ্মার নৌকা নেই। শূন্য বালির (চর) হলদে রং এদিকে নদীর নীল আর একদিকে আকাশের নীলের মাঝে একটা রেখার মতো আঁকা রয়েছে। জল কেবল উত্তরের বাতাসে অল্প অল্প চিকচিক করে কাঁপছে। ঢেউ নেই। আমি খোলা জানালার ধারে হেলান দিয়ে বসে আছি। আমার মাথায় অল্প অল্প বাতাস লাগছে, বেশ আরাম করছে। অনেকদিন তীব্র রোগভোগের পর শরীরটা দুর্বল।” কবি আরো বলেছেন “প্রকৃতির এই ধীর স্নিগ্ধ শুষ্কতা ভারী ভালো লাগছে। এই শীত শীর্ণ নদীর মত আমার সমস্ত অস্তিত্ব যেন মৃদু রৌদ্র পড়ে অলস ভাবে ঝিকঝিক করছে এবং যেন অর্ধেক আনমনে তোকে চিঠি লিখে যাচ্ছি।”

খানিকটা ভাব সম্প্রসারণ এর মতো শোনালেও বলতে হয় যে কি অদ্ভুত এর ব্যাখ্যা। এই যে চিঠি লিখে যাচ্ছি অথচ তা সত্যি নয় কিন্তু সত্যি হতেই পারত এই অনুভব আমার কাছে মহার্ঘ্য। এই দর্শন, চিন্তনের জন্যই তো তিনি রবি ঠাকুর। তাঁর সাধারণ চিঠি লেখাও তাই সাহিত্য হয়ে ওঠে অচিরে। ছত্রের পরতে পরতে থাকে প্রকৃতির প্রকাশ, মনের ভাব, চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে সেই না দেখা মূহুর্তটি। আমরা মন ভরে পড়ি সে সব শুধু, সমৃদ্ধ হই, উন্নীত হই।

লেখক পরিচিতি :- মধুমিতা বসু একজন খ্যাতনামা বাচিক শিল্পী, বেতার ও দূরদর্শনের সঞ্চালিকা, আবৃত্তি শিল্পী ও অভিনেত্রী, সর্বোপরি একজন আদ্যোপান্ত চিন্তাশীল মননের শিল্পী মানুষ।

Copyright © Kothabriksha 2021, All Rights Reserved.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.