কলেজের ক্যান্টিনে প্রথম আলাপ হয়েছিল নীলাদ্রি আর অঙ্কিতার। তখন নীলাদ্রির সবে ফার্স্ট ইয়ার শুরু হয়েছে একমাসও হয়নি। নীলাদ্রি অল্প দিনের মধ্যেই জনপ্রিয় ‘নীল’ পরিণ-এ ত হয়েছে। কলেজ ফ্রেশার্সে দারুন একটা নাটক করেছে ওদের ডিপার্টমেন্টেরই কয়েকজন মিলে। গান শুনিয়ে একেবারে সেলিব্রেটি ব্যাপার।
তবে নীলাদ্রি ভীষণ আত্মভোলা। পড়ে সোশিওলজি নিয়ে কিন্তু বেশি সময় কাটায় রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, শেলী, কীটসের সাথেই। নিজেও অল্প বিস্তর লেখালেখি করে।দেখতে ঐশ্বরিক তেমন কিছুই নয়। পাঞ্জাবিটাই বেশি পরে। তবে চোখে মুখে একটা দীপ্তি আছে। হয়তো সেটার টানেই এই কম সময়ের মধ্যেই কলেজের অনেকেই ওর বন্ধু হয়েছে। তার মধ্যে আবার মেয়েদের সংখ্যাই বেশি।
এমনিতেই স্কুলের বন্ধুরা মজা করে ওকে বলতো কৃষ্ণ – যেমন চামড়ার রঙের দিকে, তেমনি স্বভাবের দিক থেকেও। কলেজেও প্রায় একই অবস্থা। তাই এই নীলাদ্রির জনপ্রিয়তার টানেই একরকম অঙ্কিতাই প্রথম কথা বলেছিল – তবে প্রথম আলাপটা একান্তই কেজো প্রয়োজনের ছিল, ক্যান্টিনে নীলাদ্রিকে দেখতে পেয়ে অঙ্কিতা বলেছিল, ‘আচ্ছা তুমি তো নীলাদ্রি… আমাদের কলেজে একটা লিটিল ম্যাগাজিন আছে; অঙ্কুট নাম, দেখেছো বোধহয়। তুমি তো লেখালেখি কর; তাই তুমি তো আমাদের সাথে জয়েন করতে পার?’
অঙ্কিতা নীলাদ্রির সিনিয়র ব্যাচের ইংলিশ অনার্সের স্টুডেন্ট। খুব ছিমছাম। তবে বুদ্ধিদীপ্ত চেহারা। ওর ভরাট চোখের মোটা কাজলের রেখা আর রুপোর গয়না ওর সাজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখ টানে।নীলাদ্রিরও চোখ পড়েছিল ওই দিকেই – বলেছিল, ‘লেখালেখি কতটা পারি সেটা জানি না। তবে গুলতানি চলতেই পারে। আর এই রকম সঙ্গ আমার বেশ ভালোই লাগে।’ এরপর এই অঙ্কুটের প্ল্যাটফর্মেই ওরা কখন যে দুজন দুজনের কাছে তুমি থেকে তুই হয়ে গেছিল টেরও পায়নি।
কলেজে আর কলেজের বাইরে দুজনেরই পৃথিবী বেশ বড়। তবু দুজনে কয়েক দিনের মধ্যেই খুব কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিল।একসাথে বাড়ি ফিরতো। ওদের গল্পের টপিকে কি না থাকতো? রাজনীতি, কবিতা, নিজেদের অতীত – একে অপরের সাথে সময়টা ভালেই কেটে যেত, বোঝাই যেত কোথাও একটা ভালোলাগা আছে। এমনকি কলেজের বন্ধুমহলেও রটে গেল ওরা নাকি চুটিয়ে প্রেম করছে। দুজনের বাড়িতেও দুজনের পরিচিতি ছিল বেশ ভালোই। তবে কেউ কখনও প্রোপোস করেনি। সেটার দরকার যে সব সময় পরে তাও না।কিন্তু অঙ্কিতা বুঝতো যে নীলাদ্রির জীবনে বেশ কিছু রহস্য আছে – তবে সেগুলো বিশেষ ঘাটাতো না। কারণ সব সম্পর্কেই তো একটা ফাঁক থাকা দরকার। বলিউডি প্রেমটা অঙ্কিতার মোটেই পছন্দ না হলেও বোঝা যেত অঙ্কিতা নীলাদ্রিকে সত্যিই ভালোবাসে।কিন্তু এই প্রেম নিয়ে কথা উঠলেই নীলাদ্রি একেবারে অতিবাম হয়ে পড়তো – একদিন তো খুব তর্ক করেছিল, ‘প্রেম হলো একটা আরোপিত শিকল। সম্পর্কে প্রেম ঢুকলেই সম্পর্ক মরে যায়। সম্পর্কে যারা থাকে তাদের মধ্যে নিয়ন্ত্রিণ করার একটা টেন্ডেনসি চলে আসে। প্রেম তো প্রতি মুহুর্তে প্রমাণ চায়। তাই প্রেমের প্রতিষ্ঠানে আমার বিশ্বাস নেই।আমি চাই সব ভালো তে বাসা বাঁধতে, যেখানে থাকবে আশ্রয় – কোনো দায় থাকবে না।’
এরকম বহু তর্কের সময় অঙ্কিতা বুঝতে পারতো যে আর যাই হোক না কেন নীলাদ্রির ডিকশেনারিতে সংসার শব্দটা নেই। তবু নীলাদ্রির এই বিশ্বাসগুলোকে অঙ্কিতা সম্মান করত। তবে হঠাৎই একদিন প্রেম নিয়ে খুব তর্ক করছে নীলাদ্রি অঙ্কুটের মিটিং-এ – উদাহরণ দিয়ে বলেছিল, ‘এই যে আমার আর অঙ্কিতার সম্পর্কটা নিয়ে যে সবাই এতো ভাবে যে আমরা প্রেমে একেবারে হাবুডুবু খাচ্ছি! সেটা যদি সত্যি প্রেম হতো তবে কি আমাদের সম্পর্কটা এমন হত?’উত্তেজনার বশে তর্ক করতে গিয়ে নীলাদ্রি খেয়ালই করেনি যে ওর কথা গুলো অঙ্কিতা কে আঘাত করছে। অনেক আলোচনা তর্কের পর মিটিং ভেঙে যেতে হঠাৎই লক্ষ্য করেছিল, অঙ্কিতা আজ মিটিং-এ থেকেও যেন ছিল না। সবাই বেরিয়ে গেছে। অঙ্কিতা তখনও চুপ করে বসে আছে দেখে নীলাদ্রিই বলল, ‘কি রে!আজ কিছু বললি না কেন?’অঙ্কিতা তবু কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে কাছে এগিয়ে গিয়ে কাঁধটা ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, ‘কি হলো তোর আবার?’ বলা মাত্রই অঙ্কিতা এতক্ষণের সব নিয়ন্ত্রণ হরিয়ে জড়িয়ে ধরলো নীলাদ্রিকে। নীলাদ্রি প্রথমে কিছুই বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে ছিল বোকার মতো। তারপর ঠিকই বুঝলো – আবহাওয়াটা কিছুটা হাল্কা করার জন্যই বলল, ‘দেখিস আমার শার্টটায় আবার কিছুর দাগ টাগ দিয়ে বসিস না।’ বলেই খুব স্বাভাবিক একটা হাসি হেসে উঠল।
কিন্তু নাঃ! আজ ব্যাপারটা গুরুতর কিছু।আসতে করে অঙ্কিতার কাঁধটা ধরে বলল, ‘কি হয়েছে! কেউ কিছু বলেছে? বাড়িতে কিছু হয়েছে?’ এবার অঙ্কিতা মুখ তুলল – কাজলটা পুরো ঘেঁটে গেছে। চোখ দুটো চাপা কান্নার ব্যথায় পুরো লাল হয়ে উঠেছে। মুখ তুলে কিচ্ছু বলল না – নীলাদ্রির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গলার কাছে আটকে থাকা ব্যথাটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল শুধু।নীলাদ্রি কিছু বলতে যাবে অঙ্কিতা ঠোঁট দিয়ে ছুলো নীলাদ্রির ঠোঁট। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো ছিটকে গেল নীলাদ্রি। অঙ্কিতাও প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল।
বাড়ি ফিরেও কেউ কাউকে ফোন টেক্সট কিচ্ছু করল না সেদিন আর। পরদিন কলেজ গিয়ে দেখা করল না দুজনেই। তিন দিন দুজনের কেউই কোনো যোগাযোগ করল না।এই রকম বরফ জমা পরিস্থিতিতে নীলাদ্রির মন বেশ অস্থির হয়ে উঠল। চতুর্থ দিন হঠাৎই সে সোজা চলে গেল ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে।ক্লাস চলছে। তবু স্যারের অনুমতি নিয়ে ঢুকে পড়ে বলল, ‘স্যার! এখন একটু অঙ্কিতাকে ছাড়তে পারবেন?’ এরকম হঠকারী আচরণের জন্য অপমানিতও হতে হল। কিন্তু তবু ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকলো। প্রায় একঘন্টা পর স্যার বেরিয়ে যেতেই ক্লাসে ঢুকেই অঙ্কিতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চল!’
নীলাদ্রির চোখ মুখের অবস্থা দেখে অঙ্কিতা আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ বেরিয়ে এল।তারপর কলেজ থেকে বেরিয়ে উবার ক্যাব ডাকলো নীলাদ্রি নিজেই। এসি গাড়িতে বাইরের আওয়াজ আসে না। তাই গাড়ির ভিতরে নীরবতাটা যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গাড়িতে ওঠার পর অঙ্কিতা একবারও জিজ্ঞেস অবধি করেনি। কোথায় যাচ্ছে ওরা?
গাড়ি ব্যাস্ততার সব ভিড় ঠেলে যখন ময়দানের কাছে এসে থামলো তখন অঙ্কিতা যেন বাস্তবে আবার পা রাখলো। দরজা খুলে নীলাদ্রি ডাকছে,’ নেবে আয়।’ অঙ্কিতাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে মানসিক বিপর্যয়ের মাত্রাটা। চোখে কাজল নেই – নেই সেই দীপ্তি।নীলাদ্রির ডাকে সারা দিয়ে এতক্ষণে শুধু বলল, ‘এটার কোনো দরকার ছিল না কিন্তু।’নীলাদ্রি অস্থির ভাবে আবার বলল, ‘নেবে আয়।’
তারপর হাঁটতে হাঁটতে দুজনে গিয়ে বসল একটা গাছের ছায়ায়। নীলাদ্রি একটা সিগারেট ধরিয়ে উঠে দাঁড়াতেই অঙ্কিতা বলে উঠল, ‘গত দিনের জন্যে সরি। আর কোনো দিন অমন ভুল হবে না।’ নীলাদ্রি দ্রুত ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘আমার তোকে কিছু কথা বলার আছে। অনেকদিন আগেই বলা উচিৎ ছিল। কিন্তু তোদের সমাজটা জোর করে আমাদের একটা স্বাভাবিকতার মুখোশ পরিয়ে রেখেছে। আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস। সেদিনই যে প্রথম জেনেছি তা নয়। বহু দিন আগে থেকেই জানি আমি। আর হ্যাঁ, আমিও অবশ্যই তোকে ভালোবাসি।কিন্তু তোকে ঠিক বোঝাতে পারবো না। তুই যেভাবে আমাকে চাইছিস আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। কারণ – কারণ আমি গে’ বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল নীলাদ্রি। পাশে গিয়ে বসল অঙ্কিতার। এতক্ষণ অঙ্কিতা দমবন্ধ করে শুনছিল। এখন অনেকটা হাল্কা বোধ করছে। হ্যাঁ,চমকে গেছে অনেকখানি।কষ্টও যে হচ্ছেনা তা নয়।
নীলাদ্রি পাশে এসে মাথা নিচু করে বসে আছে, অঙ্কিতা শান্ত ভাবে ওর হাতটা ধরল।আজ আর কোনো কামনা নেই। জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এতোদিন বলিসনি কেন রে বোকা! তাহলে আরও একটু বেশি ভালোবাসতাম!আগের দিন তো আমাকে খুব কথা শোনালি আর আজ আমার কুর্তিটা যে ভেজাচ্ছিস তার বেলা! একদম কাঁদবি না। মুখ তোল, মুখ তোল বলছি।’
একরকম জোর করেই অঙ্কিতা নীলাদ্রির চোখ মুছিয়ে ঠোঁটে হাসি এনে বলল, ‘বাবাঃ!যখন বুক ফুলিয়ে তর্ক করিস, তখন একটুও বোঝা যায় না যে তোকে কাঁদলে এতো খারাপ দেখতে লাগে। চল ওঠ আজ একটা সুযোগ পাওয়া গেছে একসাথে সূর্যাস্ত দেখবো! ‘বলেই অঙ্কিতা নিজেও উঠলো আর নীলাদ্রিকেও হাত ধরে টান মেরে বলল, ‘কিরে চল! আর হ্যাঁ। তবে ভাবিস না যেন আমি তোকে ছেড়ে দেব। বরং এবার আরও চেপে ধরবো। মনে রাখবি আমি কিন্তু তোর থেকে বড়।’
অঙ্কিতা সত্যিই নীলাদ্রির কাছেও খুব কাছের একটা আশ্রয়। অঙ্কিতাকে বলতে পেরে ওরও খুব ভার মুক্ত লাগছে এখন। ও অঙ্কিতার হাতটা প্রায় আঁকড়ে ধরে বলল, ‘আমায় ভুল বুঝিস না লক্ষ্মীটি! এই ভাবেই সব সময় পাশে থাকিস আমার। আমি খুব একা রে।মাঝে মাঝে দমবন্ধ লাগে।’ পরিস্থিতিটাকে কিছুটা সহজ করার জন্যই অঙ্কিতা নীলাদ্রিরর মাথায় চাঁটি মেরে বলল, ‘এই যে আমার জীবনানন্দ! আজ যেমন আমায় ক্লাস করতে দিসনি। এখন নিয়ে চল প্রিন্সেপে!আর একটা কথা যত তাড়াতাড়ি পারিস কাকু কাকিমা কে বলে দিস। আর আমার পাশে থাকা না থাকা নিয়ে অতো ভাবিস না, এবার তোর আর একটুও পাশে থাকবো না – থাকবো তোর ঘাড়ে! এখন চল’।
তারপর দুজনে নৌকা করে মাঝ গঙ্গায় গিয়ে দেখলো, পশ্চিম দিগন্তে কেউ হাজার রঙের বাক্স খুলে আকাশে ঢেলে দিয়েছে সাত রঙের রামধনু আর শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যেটা ছড়িয়ে পড়েছে, ক্লান্ত শহরের বুকে।

Copyright © Kothabriksha 2021, All Rights Reserved
Adhunik Bangla Gan Ambika Ghosh benaras Bengal bengali short story coronavirus Dakshinee dreams Durga Puja Emotions folk culture Himalaya History of Indian Music India indian politics Kashmir Kobita kolkata kothabriksha kothabriksha editorial lockdown Music Nature nilimesh ray Pratyay Pratyay Raha pritam chowdhury pujo shonkhya Rabindranath Rabindranath Tagore Rabindrasangeet Religion Sayandeep Paul sharodiya shonkhya shortstory society Srabanti Sen Stories Subha Guha Thakurta Sustainable Travel Suvo Guha Thakurta Theatre travel west bengal World Environment Day