ইয়াস ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় মেডিক্যাল ক্যাম্প সংক্রান্ত রিপোর্ট – পর্ব ২

‘নদীর পাশে বাস চিন্তা বারো মাস’, এমন কথা আমরা সকলেই শুনেছি। তাই, ইয়াস পরবর্তী পরিস্থিতিতে গত ১৯শে ও ২০শে জুন, কথাবৃক্ষ পরিবার পৌঁছে গিয়েছিল দক্ষিণবঙ্গের, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অন্তর্গত নদীবহুল বদ্বীপ অঞ্চলে, যেখানে আয়োজন করা হয়েছিল তিনটি মেডিকেল ক্যাম্পের। 

সেই সময়ও এই অঞ্চলের বহুগ্রাম জলমগ্ন, প্রতিদিন জোয়ারের সময় গ্রামগুলিতে নতুন করে ভাঙ্গা বাঁধের ফাটল দিয়ে জল ঢুকছে। এবছরের মতো চাষাবাদের কাজ বন্ধ। তার ওপরে বর্ষার অবিরাম বৃষ্টি। এই সব মিলিয়ে নতুন করে বন্যা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে। একদিকে করোনা আর লকডাউনে কাজ চলে যাওয়া, জলের অভাব, খাদ্যের অপ্রতুলতা – তার উপরেই জলবাহিত নানা রোগ, অজানা জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন এই সকল অঞ্চলের বহু মানুষ। তাই আমরা ৩ জন সহৃদয় অভিজ্ঞ ডাক্তার সহ পৌঁছে গিয়েছিলাম এই অঞ্চলগুলিতে, যেখানে আমরা গ্রামের অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছি ডাক্তারি পরিষেবা, প্রয়োজনীয় ওষুধ ও স্যানিটারি ন্যাপকিন।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বাসন্তী ব্লকের অন্তর্গত নফরগঞ্জে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং গোসাবা ব্লকের অন্তর্গত দুলকি এবং ইরফানখালিতে এই মেডিকেল ক্যাম্পের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই অঞ্চলের মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেল যে সরকার জুলাই মাস থেকে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলেছিল তা আসলে খুবই নির্বাচিত ও নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের জন্যই বরাদ্দ। কিন্তু এই সকল অঞ্চলের মানুষের মতে, গোসাবা দ্বীপটিতে সকল মানুষেরই যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তার কাছে এই ক্ষতিপূরণ অপ্রতুল। এর প্রধান কারণ হল গোসাবায় যে ধানি জমি আছে তা এক-ফসলি, বর্ষায় সেখানে ধান বোনা হয় এবং অঘ্রান-পৌষ মাস নাগাদ সেই ধান কাটা হয়। অর্থাৎ এইবছর এই অঞ্চলের কোন ধানি জমিতে ধান বোনা আর সম্ভব নয়। অতএব গতবছরের ধান কিছুটা সঞ্চিত থাকলেও আগামী বছরের জন্য এই অঞ্চলের মানুষদের কাছে আর ধানের কোন যোগান থাকবে না, সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত। সেই সঙ্গেই জানা গেল যে এই অঞ্চলগুলিতে চিকিৎসা ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল তার কারণ এই গোসাবা এবং বাসন্তীর সবচেয়ে কাছে যে সদর হাসপাতালটি রয়েছে তার দূরত্ব গোসাবা থেকে প্রায় ৯২ কিলোমিটার। লকডাউনের কারণে রাস্তায় যানবাহন নেই, তাই এই দূরত্ব অতিক্রম করে মানুষের পক্ষে ডাক্তার দেখাতে যাওয়াও সম্ভব নয়। কাজেই চারিপাশের নোংরা পচা জলেই দিন কাটছে তাদের। সঙ্গে মাছ-পচা দুর্গন্ধ, জলবাহিত নানা রোগ, রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকার আর পানীয় জল ও খাদ্যের অভাব। এই দৃশ্য যে কি দুর্বিষহ, তা ভাষায় বলে বোঝানো কঠিন।

এই কাজটি করতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে যে অনেক ভাগ্য করলে বোধহয় শহরে বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলা যায় যে একটি মেট্রোপলিটন সিটিতে জন্মগ্রহণ করা যায়। এই আশীর্বাদ বোধহয় সত্যি সত্যিই অনেক জন্মের পুণ্যের ফল থেকেই প্রাপ্ত হয়। এই কথা বলার প্রধান কারণ হল গদখালি, সোনাখালি, গোসাবা, এইসকল অঞ্চলগুলিতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা আমরা সঞ্চয় করেছি, তা প্রমাণ করে দেয় যে এই দেশের হাতেগোনা কয়েকটি শহরের বাইরে যে বিপুল গ্রামাঞ্চল রয়েছে সেই সকল গ্রামের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। কেবলমাত্র প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলেই নয়, স্বাভাবিকভাবে এইসকল জায়গাগুলি এখনো অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে কাগজে-কলমে। বিদ্যুৎ পৌঁছেছে ঠিকই কিন্তু সেই কানেকশনে মিটার বক্স ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া আলো ছাড়া আর কিছুই কাজ হয়না। তার উপরে এই দুর্যোগের পর সমস্ত ইলেক্ট্রিকের তার জলের তলায়। দিনের আলো নিভলেই গ্রামগুলি ঢেকে যায় এক গভীর অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। 

এই অন্ধকারের চেয়েও আরও ভয়ানক এক অন্ধকার জমাটবদ্ধ হয়ে এক গভীর ক্ষত তৈরি করে এইসব অঞ্চলের মানুষদের জীবনে, যার প্রতক্ষদর্শী আমরা। শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবে কোন মহিলাকে চিকিৎসার কারণে তার বয়স জিজ্ঞাসা করলে তিনি একই সাথে তিনটি বা তারও বেশি সংখ্যা বলেন। খালি পায়ে ডাক্তার দেখাতে আসা কোন ব্যক্তি বা মহিলাকে যদি বলা হয় যে কেন তিনি খালি পায়ে এসেছেন, তার উত্তরে তিনি বলেন যে পেটের ভাত জোটানোই যেখানে কঠিন সেখানে পায়ের জুতো বিলাসিতা। এই উত্তর থেকেই বোঝা যায় যে আমাদের দেশের বিপুল গ্রামাঞ্চল এখনও কতটা পিছিয়ে রয়েছে।

আর একটি ছবিও এই প্রতিবেদনের সকলের সামনে তুলে না ধরলেই নয়। বহু মানূষ এখানকার মানুষের দরকার না বুঝেই, শুধুমাত্র আত্মতুষ্টির জন্য ত্রাণ নিয়ে চলেছেন। যেখানে ত্রাণ বিতরণ শুধুমাত্র এক অজুহাত, মূল উদ্দেশ্য লকডাউনের গৃহবন্দী জীবনের ফাঁকে একটা পিকনিকের আয়োজন। এমন বহু লঞ্চ আমাদের চোখে পড়লো, যারা সাউন্ড সিস্টেম বাজিয়ে, নাচ-গান করতে করতে, নদীপথে ত্রাণ দিতে চলেছেন। এক একটি লঞ্চ ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে এগিয়ে চলেছে আর নদীর দুই পাড়ে সেই লঞ্চগুলির সাথে সাথে ছুটছে অগণিত অসহায় মানুষের দল, জলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে কিছু মানুষ, ত্রাণের আশায় হাত বাড়িয়ে। এর থেকেই আরেকটা বিষয়ও পরিষ্কার বোঝা যায় যে সরকারি ত্রাণ এই সকল অঞ্চলের মানুষের সংখ্যা অনুপাতে কতটা অপ্রতুল।

খাদ্যের অভাবের থেকে অনেক বেশি কষ্টকর দৃশ্য, যে চারিপাশে গলা পর্যন্ত জল, কিন্তু পানীয় জল এক ফোঁটাও নেই। সমস্ত টিউবকল জলের তলায়। এবিষয় একটা ঘটনা বলতেই হয়। আমরা যখন দ্বিতীয় দিন ক্যাম্প শেষ করে নৌকায় ওঠার জন্য ঘাটের দিকে এগোচ্ছি, তখন দুই মহিলা ছুটতে ছুটতে এলেন আমাদের দিকে। আমরা তাদের ছুটে আসার কারণ জিজ্ঞেস করায়, তারা বললেন যে একটি সংস্থা সকাল ১০ টায় ত্রাণ দেবে বলে, নদীর পারে অপেক্ষা করতে বলেছিল গ্রামবাসীদের। সেই ত্রাণ এসে পৌঁছায় বিকেল ৪ টের সময়। তাই ডাক্তার দেখাতে আসতে দেরী হয়েছে। শেষে ত্রাণ পাওয়ার পর প্যাকেট খুলে তারা দেখেন যে ১ টি মুড়ি, ১ টি বিস্কুট ও ১ টি চিঁড়ের প্যাকেট। প্রচন্ড বীতশ্রদ্ধ হয়ে তারা আমাদের কাছে বলেন, যে এই খাবারের চেয়ে এক বোতল পানীয় জল দিলে তাদের অনেক উপকার হত, এই বলতে বলতে তাদের দুচোখ ভরে জল চলে আসে। আমরাও অসহায়ের মতন খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলাম তাদের দিকে। অবশেষে ডাক্তারবাবুরা রাস্তায় দাঁড়িয়েই তাদের রোগের কথা শুনে ২ মাসের ওষুধ দিয়ে দিলেন এবং আমাদের হাতে নিজেদের যে পানীয় জলের একটি ২ লিটারের বোতল ছিল, তা আমরা তাদের দিলাম। বলার ব্যাপারটা এটাই, যে ওই ওষুধ বা ত্রাণ সামগ্রীর থেকেও জলটা পেয়ে তারা প্রাণ ভরে কিছুটা জল খেলেন, আর বাকিটা বাড়ির লোকের জন্যে নিয়ে গেলেন। নৌকা করে ফিরে আসবার সময়, যখন মাঝি ভাই ঘাট থেকে নৌকার দড়িটা খুলে নিল, পশ্চিমের আকাশে অন্ধকার নেমে আসছিল, শুধু মনে হচ্ছিল যে একটা আলাদা জগৎ পরে রইলো নদীর এপারে। আমরা ফিরে চলেছিলাম আলোয় ভরা ঝকঝকে দুনিয়ায়, আর লক্ষ লক্ষ মানুষ পরে রইলো পচা-গলা জলে, অন্ধকারের আচ্ছাদনে।

এই সম্পূর্ণ ক্যাম্পের সময়টা ছিল বর্ষাকাল। তাই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বহু অসুবিধের সম্মুখীন হতে হয়েছে আমাদের। তবুও, আমরা চেষ্টা করেছি ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পরবর্তী সময়ে এবং বর্ষাকালে এই সকল অঞ্চলের মানুষদের যেসকল অসুস্থতার শিকার হতে হয় বা হয়েছে, তার জন্য কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার এবং সেই কারণেই এই মেডিকেল ক্যাম্পগুলির আয়োজন। যদিও আমরা জানি আমাদের এই চেষ্টা ও আমাদের মত এমন বহু সংগঠনের চেষ্টা এই সকল অঞ্চলের মানুষদের ক্ষয় ক্ষতির কাছে তুচ্ছ, কারণ যেখানে ভারতবর্ষের অধিকাংশ মানুষই গ্রামকেন্দ্রিক সভ্যতার উপর নির্ভর করে সেখানে সার্বিক গ্রামীণ উন্নয়ন যথার্থরূপে সরকারের পক্ষেই সম্ভব। তাও আমরা চেষ্টা করেছি এবং আগামীতেও চেষ্টা করব যাতে এই ভাবেই মানুষের পাশে, মানুষের সাথে আমরা থাকতে পারি। এই সম্পূর্ণ কাজটিতে আমরা পাশে পেয়েছি শপথ, সুরকাহন এবং সেভিং টাইগার সোসাইটির মতন বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে। সঙ্গে ছিল আপনাদের ভালোবাসা ও বহু মানুষের সাহায্য, যা ছাড়া এই কাজ একেবারেই অসম্ভব ছিল। আমরা আশা করি আপনারা আগামীতেও আমাদের সঙ্গে থাকবেন ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন।

অনুলিখনঃ নীলিমেশ রায়

স্থিরচিত্র ও সম্পাদনাঃ শুভ্রদীপ আকাশ

নীলিমেশ রায়, শুভ্রদীপ আকাশ

নীলিমেশ ও শুভ্রদীপ কথাবৃক্ষ সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক। কথাবৃক্ষ এর এই ইয়াস রিলিফ এর কাজে এঁরা প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের ভাষা ও ছবিতে এই কাজের বর্ণনা তুলে ধরেছেন এই লেখায়।

Adhunik Bangla Gan Ambika Ghosh benaras Bengal bengali short story coronavirus Dakshinee dreams Durga Puja Emotions folk culture Himalaya History of Indian Music India indian politics Kashmir Kobita kolkata kothabriksha kothabriksha editorial lockdown Music Nature nilimesh ray Pratyay Pratyay Raha pritam chowdhury pujo shonkhya Rabindranath Rabindranath Tagore Rabindrasangeet Religion Sayandeep Paul sharodiya shonkhya shortstory society Srabanti Sen Stories Subha Guha Thakurta Sustainable Travel Suvo Guha Thakurta Theatre travel west bengal World Environment Day

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.