বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের কাছে বহুল পরিচিত ও জনপ্রিয় মন্দির হল ঢাকেশ্বরী মন্দির, এটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত। শুধু তাই নয় এই মন্দিরটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম জাতীয় মন্দির। শোনা যায় ঢাকার নামকরণ হয়েছে “ঢাকার ঈশ্বরী” অর্থাৎ ঢাকা শহরের রক্ষাকর্ত্রী দেবীর নামের সূত্র ধরেই।

এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। মনে করা হয় যে, সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন ১২শ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। কিংবদন্তীগণ বলছেন যে বল্লাল সেন একবার জঙ্গলে আচ্ছাদিত দেবতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বল্লাল সেন সেখানে দেবীকে আবিষ্কার করেন এবং একটি মন্দির নির্মাণ করান, মূর্তিটি ঢাকা ছিল বলেই দেবীর এরূপ নাম। পক্ষান্তরে একথাও শোনা যায় যে কোন এক রানী দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। রানীকে দেবী স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন যে, তিনি জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চলে আচ্ছাদিত হয়ে যাচ্ছেন অর্থাৎ ঢাকা পড়ে আছেন – এই কথা রানী যেন রাজাকে জানান এবং সেই মন্দির উদ্ধার করে রাজা যেন অবশ্যই দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। দেবীর এই স্বপ্নাদেশ পেয়েই রানী রাজা কে সব বৃত্তান্ত জানান এবং রাজা সত্যি সত্যি একটি জঙ্গলের মধ্যে গাছপালায় ঢাকা শতাব্দীপ্রাচীন ভগ্ন মন্দির দেখতে পান। যেহেতু মন্দির ঢাকা ছিল তাই নাম হয় ঢাকেশ্বরী। তবে এই সকল কিংবদন্তীর ঐতিহাসিক প্রমান পাওয়া যায় না। ঐতিহাসিক ভাবে এ কথাই বলা যায় যে, ৮০০বছর আগে মুঘল সম্রাট আকবরের সেনাপতি মানসিংহ বঙ্গদেশ জয় করলে, তিনি এই ঢাকেশ্বরী মন্দিরে একটি সোনা প্রধান অষ্টধাতুর সপরিবারে মহিষমর্দিনী’র মূর্তি নির্মাণ করান। এই মূর্তিটি নির্মাণ করেছিলেন এক জয়পুরের শিল্পী। সেই কারণেই মূর্তিটির গঠনশৈলীর মধ্যে অনেকাংশেই রাজস্থানী শিল্প-ভাবনার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে দেবীর সিংহবাহনটি যদি লক্ষ্য করা হয় তাহলে স্পষ্টতই বোঝা যাবে যে তার মধ্যে মরুভূমি অঞ্চলের শিল্পশৈলীর প্রকাশ ঘটেছে। মানসিংহ যে কেবলমাত্র মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা নয় আজমগড় থেকে এক তেওয়ারি পরিবারকে এনে সেই মন্দিরের সেবায়েতও ঠিক করে দিয়েছিলেন। তারপর দীর্ঘদিন দেবী ঢাকেরশ্বরী ঢাকা শহরেই পূজিতা হয়েছেন। কিন্তু ১৯৪৭-এ দেশভাগ পরবর্তী সময়ে ১৯৪৮ সালে যখন দুই বাংলায় দাঙ্গা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে তখন কলকাতার হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিট নিবাসী ওপার বাংলা থেকে আসা দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরী নামের এক বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী নির্দেশ দেন যে দেবী ঢাকেশ্বরীকে অসুরক্ষিত শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় ঢাকায় না রেখে কলকাতায় নিয়ে আসা হোক। দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরীর এই নির্দেশে দেশভাগ-পরবর্তী দাঙ্গার সময় সম্ভাব্য আক্রমণ এবং লুন্ঠনের হাত থেকে দেবীকে রক্ষা করতেই ঢাকার মূল বিগ্রহটিকে গোপনে এবং দ্রুততার সঙ্গে ১৯৪৮-এ কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন রাজেন্দ্রকিশোর তিওয়ারি (মতান্তরে প্রহ্লাদকিশোর তিওয়ারি) এবং হরিহর চক্রবর্তী। দেবীকে আসতে হয়েছিল নিরাভরণ হয়ে বাক্সবন্দী অবস্থায়। কলকাতায় প্লেনে করে এসেছিলেন দেবী। দেশভাগের সময় কয়েক লক্ষ ভিটেমাটি হারা মানুষের সঙ্গে দেবী ঢাকেশ্বরীকেও ঢাকা থেকে কলকাতায় আসতে হয়েছিল।
১৯৪৮ সালে কলকাতায় এসে – ১৯৫০ সাল অবধি, এই দু’বছর দেবী ঢাকেরশ্বরী ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরীর বাড়িতে। ১৯৫০ সালে দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরী’ই উত্তর কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চলের দুর্গাচারণ স্ট্রিটে বর্তমান মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেটিই হলো কলকাতার শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দির। এই মন্দিরে আজও দেবী ঢাকেশ্বরীর ৫০০ বছরের পুরনো বিগ্রহটি অধিষ্ঠিত আছে। মন্দির ও মন্দির সংলগ্ন একটি বাড়ি বর্তমানে দেবীর স্থাবর সম্পত্তি। যেহেতু দেবীকে অকালে ঢাকা থেকে কলকাতা নিয়ে আসা হয়েছিল তাই দেবীমুর্তির সঙ্গে এই মন্দিরে রাম ও হনুমানের প্রস্তর মূর্তি বর্তমান। একচালা মূর্তির একেবারে উপরে আছেন দেবাদিদেব মহাদেব। গণেশের গায়ের রং রক্তাভ এবং বাকি সকলের পীতবর্ন।
বর্তমানে এই আদি ঢাকেশ্বরী মন্দির দেবী নিত্য পূজা পান। সেই আজমগড়ের সেবায়েত পরিবারের বংশধরেরাই আজও দেবী দৈনন্দিন পূজা চালিয়ে আসছেন। সকালে দেবীকে দেওয়া হয় হল নৈবেদ্যের প্রসাদ, দুপুরবেলায় প্রতিদিন দেবী গ্রহণ করেন অন্নভোগ, সন্ধ্যাবেলায় আরতী পর দেবীকে দুধ মিষ্টি দিয়ে সেবা করা হয় – তারপর দেবী শয়ণে যান।

এছাড়াও দেবীর বাৎসরিক পূজা নির্বাহ হয় আশ্বিন মাসের অকালবোধন দুর্গোৎসবের সময়। এই মন্দিরে দেবী মাতৃরূপেই পূজিতা। যেহেতু দেবী প্রতিষ্ঠিতা তাই দুর্গোৎসবের সময় কোন প্রকার বোধন বা অধিবাসের রীতি প্রচলিত নেই। দুর্গোৎসবের সময় প্রতিপদ থেকে দশমী অবধি পূজা চলে – নবরাত্রি রীতি মেনে। এই মন্দিরে নবপত্রিকা স্থাপনেরও কোন রীতি নেই। শাক্ত মতে পূজা হলেও দেবী আমিষাশী নন এবং কোন প্রকার পশুবলি এই মন্দিরে হয়না। সন্ধি পূজার সময় শুধুমাত্র চালকুমড়ো বলির রীতি রয়েছে। কুমারী পূজা বা সধবা পূজার কোন প্রচলন এই মন্দিরে নেই। দুর্গোৎসবের সময় ঘট স্থাপনের একটি বিশেষ রীতি প্রচলিত আছে – দেবী মূর্তির সামনে তিনটি ঘট প্রতিষ্ঠা করা হয়, ঘট গুলিতে কোন প্রকারের ডাব বা নারিকেল দেওয়ার প্রচলন নেই। ঘট গুলির গায়ে বিশেষ্ রূপে গোবর মিশ্রিত মাটি লাগানো হয় এবং তাতে জবের শস্য-বীজ বসানো থাকে, ধীরে ধীরে সেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে জবের কচি গাছ ঊর্ধ্বমুখী হয়। ঘটের উপরে বসানো থাকে চতুর্মুখী প্রদীপ। দশমীর দিন এই ঘট বিসর্জন এর মাধ্যমেই বাৎসরিক দুর্গোৎসব সমাপ্ত হয়।
দুর্গাপূজার সময় দেবীকে নানা প্রকার অন্নভোগ নিবেদন করা হয়। কলকাতায় আসার পর থেকেই প্রায় ৭০ বছর জনৈক ঘোষাল পরিবারের পূজারীরাই দেবীর নিত্য পূজা ও বাৎসরিক পূজার কাজ করে আসছেন। বর্তমানে শক্তিপ্রসাদ ঘোষাল মহাশয় প্রায় ৪০ বছর সময়কাল ধরে দেবীর পূজার দায়িত্বে আছে।
সত্যি ভাবতে অবাক লাগে, ঢাকা শহর নাম যে দেবীর নামে, সেই দেবীর আদি মূর্তি আজও আমাদের কলকাতাতেই বর্তমান এবং এই ঐতিহাসিক সম্পদকে অবশ্যই আমাদের রক্ষা করতে হবে – কারণ দেশের অরাজক পরিস্থিতিতে ঢাকেরশ্বরী দেবীর ঐতিহ্য ও সম্মান রক্ষার জন্যেই এগিয়ে এসেছিলেন কলকাতার দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরী, তার সেই প্রতিষ্ঠা কে আসুন আমরা এগিয়ে নিয়ে যাই এবং সেই সঙ্গে এই ঐতিহাসিক পরম্পরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত করে দিই।

Copyright © Kothabriksha 2021, All Rights Reserved.
Adhunik Bangla Gan Ambika Ghosh benaras Bengal bengali short story coronavirus Dakshinee dreams Durga Puja Emotions folk culture Himalaya History of Indian Music India indian politics Kashmir Kobita kolkata kothabriksha kothabriksha editorial lockdown Music Nature nilimesh ray Pratyay Pratyay Raha pritam chowdhury pujo shonkhya Rabindranath Rabindranath Tagore Rabindrasangeet Religion Sayandeep Paul sharodiya shonkhya shortstory society Srabanti Sen Stories Subha Guha Thakurta Sustainable Travel Suvo Guha Thakurta Theatre travel west bengal World Environment Day