বর্ধমান জেলার মেমারির পাহাড়হাটি তে রয়েছে ৩০০ বছরেরও পুরোনো দত্ত বাড়ি। কথাবৃক্ষ থেকে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম সেখানে। দত্ত বাড়ির চতূর্থ প্রজন্ম সৌকান দত্তের সাথে আমাদের কথা হয় এবং আমরা জানতে পারি দত্ত বাড়ির দূর্গা পুজোর ইতিহাস এবং বেশ কিছু অজানা তথ্য।

বর্তমান দত্ত বাড়ি থেকে প্রায় ৪০-৫০ কিমি দূরে কাইগা-রাইগা নামে একটি গ্রাম আছে। সেই গ্রামে এক জমিদার বাড়িতে দূর্গা পুজো হতো। সম্পত্তি নিয়ে অশান্তি হওয়াতে সেই জমিদার বাড়ির ছোট ছেলেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। বাড়ি ছাড়ার সময় ছেলেটির হাতে ছিল ঘন্টা, চন্দন কাঠ এবং চন্দন পাতা, এটুকুই জুটেছিল তার ভাগে। কাইগা-রাইগা থেকে পাহাড়হাটিতে এসে সেই ছেলে, মাটির ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করে এবং তিনি দুর্গাকে স্বপ্নে দেখেন। স্বপ্নে তাকে দেবী বলেন “আমি তোমার কাছে আসছি , তুমি আমার পুজো করো।” উত্তরে ছেলেটি মা কে জানায় যে তার কাছে কিছুই নেই পুজো করার মতন এবং তাই সে পুজো করতে অক্ষম। এরপরই মা তাকে আদেশ দিয়ে বলেন “আমার পুজো করো, তোমার সবকিছু হবে।”
পরদিন সকালে বর্ধমানের বাঁকা নদীতে ভেসে আসে একটি কাঠামো। সেই কাঠামোতেই প্রথম পুজো শুরু করেছিল সেই জমিদার বাড়ির ছোট ছেলে এবং সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই ৩০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই কাঠামোতে এখনো পুজো হয়।

বাড়ি থেকে বিতাড়িত ছোট ছেলেকে তার পুজো করার স্বপ্ন দেখালেও, মা কিন্তু কাইগা-রাইগার জমিদার বাড়ির সদস্যদের স্বপ্নে তার মুখদর্শন না করার আদেশ দিয়েছিলেন এবং তারপর থেকেই কাইগা-রাইগার গ্রামের বাড়ির পুজো রূপান্তরিত হয়েছিল বারোয়ারি পুজোতে।
জানা যায় যে সেই পুজোর দুর্গামূর্তি রূপ বেশ উগ্র।
কাইগা-রাইগা গ্রামের জমিদার বাড়ির ছোট ছেলের পুজো চলতে থাকে বহু বছর, কিন্তু তারপর সেই পুজো দে বাড়ির পুজো হয়ে যায়। যদিও দে বাড়ির পুজো কিভাবে শুরু হয় তা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়, তাই সেটা আমরাও জানতে পারিনি। কিন্তু এর পরবর্তীতে দে বাড়ি থেকে সেই পুজো কিভাবে দত্ত বাড়ির পুজো হয়ে ওঠে সেটা বরং আপনাদের সাথে ভাগ করে নি।
আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে দে বাড়িতেও সেই একই ঘটনা ঘটে। সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা হওয়ার ফলে পুজোর দায়িত্ব নেওয়ার মতো আর কেউ থাকে না। শেষমেশ বাড়ির জামাই বিজয় কৃষ্ণ দত্ত অর্থাৎ গোলাপমণি দাসীর মেয়ে প্রফুল্ল বলা দাসীর স্বামী কর্মযজ্ঞের দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নেন। তখন থেকেই দে বাড়ির পুজো পরিবর্তিত হয়ে যায় দত্ত বাড়ির পুজোয়। বিজয় কৃষ্ণ দত্তের ছিল সিমেন্ট এর ব্যবসা। মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি মারা জান।

দত্ত বাড়ির দেবী দূর্গার অভয়া মূর্তি, দেবী দ্বিভুজা। মূর্তির নীচে সিংহ এবং মহিষাসুর থাকে না। দেবীর দুইপাশে থাকেন জয়া ও বিজয়া। কার্তিক আর গণেশের বাহন থাকলেও লক্ষী ও সরস্বতীর বাহন থাকেনা কারণ দত্ত বাড়িতে দুর্গা সহ লক্ষী এবং সরস্বতী ত্রিদেবী হিসেবে পূজিত হন। এই একশো বছরের পুরোনো পুজো হয় তন্ত্র মতে। দেবী দুর্গা পঞ্চমুন্ডীর আসনের উপর অধিষ্ঠাত্রী।

নতুন থান কাপড় ধোপাবাড়ি থেকে কাচিয়ে এনে পরানো হয় মাকে। মায়ের গায়ে থাকে সোনা এবং রুপোর অলংকার।
দত্ত বাড়ির বোধন হয় প্রতিপদে, সপ্তমীর দিন নবপত্রিকা স্থাপিত হয় এবং মায়ের পুজোর ঘট বসে, সেই ঘট বংশ পরম্পরায় জল ভরে মাথায় করে নিয়ে আসেন এই বাড়িরই ছেলে। এছাড়াও ভিতরের একটি ঘরে বসানো হয় কুবেরের ঘট।
অষ্টমীর সন্ধ্যেতে প্রদীপ জ্বালানো এবং তারপর হয় সন্ধি পুজো, ধুনো পোড়ানোর রীতি ও রয়েছে এই পুজোয়। নবমীর দিন হয় কুমারী পুজো এবং দশমীর দিন এখনো রয়েছে নীলকণ্ঠ পাখি দেখতে যাওয়ার নিয়ম। আর সবশেষে তো সিঁদুর খেলা আর কাঠামো বিসর্জন থাকেই।
এই বাড়ির পুজোয় মিষ্টির বদলে মণ্ডা ভোগ দেয়া হয়, ভোগে দেওয়া হয় কাঁচা চাল আর ডাল। সন্ধ্যা আরতির সময় দেওয়া হয় লুচি, নাড়ু ও মুড়কি। বিসর্জনের পর দেবীর কাঠামো তুলে রাখা হয় বেদিতে। সারাবছরই সন্ধ্যবাতি দেওয়া হয় এই দুর্গাদালানে।
সৌকানের থেকে এই গল্প শুনে বারবার শুধু একটাই কথা মনে হচ্ছিল যে এই পুজোর আয়ু দীর্ঘায়ীত হোক, আরো অনেক গল্প ও ইতিহাস তৈরী হোক দত্ত বাড়ির ঠাকুরদালানে।

Copyright © Kothabriksha 2021, All Rights Reserved.
Adhunik Bangla Gan Ambika Ghosh benaras Bengal bengali short story coronavirus Dakshinee dreams Durga Puja Emotions folk culture Himalaya History of Indian Music India indian politics Kashmir Kobita kolkata kothabriksha kothabriksha editorial lockdown Music Nature nilimesh ray Pratyay Pratyay Raha pritam chowdhury pujo shonkhya Rabindranath Rabindranath Tagore Rabindrasangeet Religion Sayandeep Paul sharodiya shonkhya shortstory society Srabanti Sen Stories Subha Guha Thakurta Sustainable Travel Suvo Guha Thakurta Theatre travel west bengal World Environment Day