সাতরঙা স্বপ্ন – রূপকথা

আজ ঝির ঝির করে বৃষ্টি হচ্ছে সারাদিন। আশেপাশের পাহাড়ী সবুজ সব ধুয়ে গিয়ে আরও ঝকঝকে। ধোঁয়ার মত সাদা কালো মেঘ গুলো মাঝে মাঝেই পথ ভুলে ঢুকে পড়ছে ক্যাফের আধখোলা জানলা দিয়ে। জানলার ধারের কোনের টেবিলটায় বসে কাপে চুমুক দেন ঋদ্ধি গুপ্ত। আবহাওয়ার বিষণ্নতা যেন আজ ছুঁয়ে দিয়েছে তাঁকেও। আজ তাঁর খুব রামধনু দেখতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা, বিদেশের আকাশে কি রামধনু দেখা যায়? জানেন না ঋদ্ধি। লক্ষ্য করে দেখা হয়নি কখনও এতগুলো বছরেও।

আজ খুব মোহনপুরের কথা মনে পড়ছে। ছোটবেলা থেকে কিশোর বয়স অবধি কতগুলো স্কুলের ছুটি কেটেছে এই গ্রামে। বাবার পিসির বাড়ি। মাঠের পর মাঠ, যতদূর চোখ যায় ধান ক্ষেত। বর্ষার ভেজা হাওয়ায় দুলতে থাকা ধানের শীষ, দূরে মেঘের ঘনঘটা, ক্ষেতের আল ধরে ছুটে বেড়ানো, ঠাকুমার চিৎকার করা সাবধান বাণী, ‘ওরে ধানগাছের গোড়ায় সাপ থাকে, যাসনি..’ – সব কেমন অন্য এক যুগের, অন্য জন্মের কথা মনে হয় ঋদ্ধির। এখানেই রামধনু দেখেছিল প্রথম। বৃষ্টি শেষে পড়ন্ত বিকেলে, আর এখানেই প্রথম নিজের শরীরে রামধনু রঙের অস্তিত্ব টের পেয়েছিল।

বয়ঃসন্ধির পর থেকেই ছোট্ট মেয়েটির অস্বস্তিগুলো তৈরি হতে থাকে। এই শরীর যেন তার নয়। যেন জোর করে তার মনকে, সত্ত্বাকে এই শরীরের মধ্যে কেউ বেঁধে রেখেছে। সে মনে হয় ছেলেদের সাথে, ছেলেদের পোশাকে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ। সুন্দর সুন্দর মেয়েলি পোশাকের প্রতি অচিরেই একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হতে থাকে। আর এইরকম অদ্ভুত মানসিক টানাপোড়েন সেই বয়সে সামলাতে না পেরে আরও গুমড়ে থাকে। মুখচোরা এই মেয়েটিকে নিয়ে বাবা মাও চিন্তায় থাকেন। মন খুলে সব কথা বলেছিল শুধু একজনকে। পিঙ্কি। সেই মোহনপুরের ঠাকুমার বাড়ির পাশেই থাকে। তার সবথেকে প্রিয় বন্ধু। মোহনপুরের বিকেলগুলোতে সাড়া গ্রাম চষে বেড়াত ওর সাথে। সেবার গরমের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে চেপে রাখা সব অস্বস্তি, ভয়, কষ্ট উজাড় করে বলেছিল পিঙ্কিকে মাঠের শেষে বড় ঝিলটার পাড়ে পা ঝুলিয়ে বসে। ওই বয়সে পিঙ্কি কি বুঝেছিল কি জানি, মাথা নেড়ে বিজ্ঞের মত বলেছিল, ‘ভালই তো হয় তুই ছেলে হলে, বড় হয়ে তবে বিয়ে করবি আমায়। আমরা একসাথে থাকতে পারব’। তখন এই কথার কতটা গুরুত্ত্ব ছিল ঋদ্ধির কাছে তা আজ জানা নেই কিন্তু এই কথায় কিছু একটা যেন পালটে গেছিল সেই মুহূর্ত থেকে। পিঙ্কিকে দেখার দৃষ্টিটাও বোধহয়।

এইভাবে কেটে যায় আরও ক’টি বছর। দুজনেই বড় হয়েছে আরেকটু। দুজনের মধ্যেকার টানও বেড়েছে। পড়াশোনার চাপের জন্য ঋদ্ধি এখন বছরে একবারের বেশি আসতেও পারেনা। তাতেও বন্ধুত্বে ভাঁটা তো পড়েইনি উলটে গাঢ় হয়েছে। গ্রামে বেড়ানোর ফাঁকে একটু হাতে হাত, দুজনের শরীরের ছোঁয়া যেন অন্য এক গল্প বলে যায় কানে কানে। গ্রামেও ঠারে ঠোরে রটতে থাকে কথা। ‘বড় বাড়ির কলকেতার নাতনিটা যেন কিরকম। ছেলেদের মত পোশাক পরে, ছেলেদের মত হাঁটাচলা..আমাদের পিঙ্কিটার পিছু ছাড়ে না, কেমনতর হাবভাব যেন.. ডাইন ধরল নাকি রে..’ ঠাকুমার কানেও আসে সেইসব চর্চা, আজকাল নাতনির সামনে বেশী গম্ভীর থাকেন, বলেন, ‘আসিস কদিনের জন্য, ঘরে থাকিসনি কেন? অত মেলামেশার কি দরকার ওদের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে?’ কিন্তু যৌবনের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো দুটি অবুঝ মন কি সে কথা মানতে চায়?

সেও ছিল এক বর্ষার দিন। বৃষ্টির জন্য কোথাও বেড়তে পারেনি দুজন। ঋদ্ধির ভারি ইচ্ছে করছিল পিঙ্কির সাথে আলাদা সময় কাটাতে। এবারের পর অনেকদিন আসতে পারবে না সে। সামনে উচ্চমাধ্যমিক, পর পর আরও সব পরীক্ষা। শেষ পর্যন্ত ওরা দেখা করে বাড়ির সীমানার শেষ প্রান্তে পড়ে থাকা খালি গোয়ালঘরটায়। তাড়াহুড়ো করে সবার চোখ এড়িয়ে এসেছে পিঙ্কি। বৃষ্টির জলের ছিটে পড়েছে মুখে। গোলাপী রঙের স্কার্ট, চুলটা পনিটেলে বাঁধা। কি সুন্দর লাগছে আজ ওকে। ঋদ্ধির চোখে আজ ঘোর লাগে। পিঙ্কির চোখের কোনও কি ভিজে? ‘তুই এরপর অনেক দূরে চলে যাবি বল পড়তে?’ আস্তে আস্তে এগিয়ে আসে ঋদ্ধি। দুজনে দুজনের হাত ধরে। ধীরে ধীরে গোয়াল ঘরের আবছা আলোয় অনভ্যস্ত দুজোড়া ঠোঁট খুঁজে নেয় একে অপরকে।

কয়েক মুহূর্ত মাত্র। হঠাৎ হইহই চিৎকার শব্দে চমকে কেঁপে উঠে ছিটকে সরে যায় দুজন। ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। গ্রামের লোক এবার তক্কে তক্কে ছিল। গ্রামের মেয়েকে ডাইনের পাল্লায় পরতে দেওয়া যায় নাকি? এর বিহিত তো তাদেরই করতে হবে! পিঙ্কিকে বের করে এনে এলোপাথারি মার শুরু হয় ঋদ্ধির ওপর। জামাকাপড় ছিঁড়ে দেওয়া হয়। ভেতরটা তারস্বরে প্রতিবাদ জানালেও মারমুখী লোকগুলোর সামনে পিঙ্কির গলা দিয়ে স্বর বেড়োয় না ভয়ে! ভিড়ের মধ্যে কারা যেন বলে ওঠে, ‘পুড়িয়ে মার ডাইনিটাকে… এ পাপ.. গ্রামের অকল্যাণ… আমাদের গ্রামের মেয়েকে তুক করা…’ যেমন বলা, আগুনে ঘি পড়ার মত রোষে ফুঁসে ওঠা মূর্খ জনতা যেন নরপিশাচ হয়ে যায়।

গোলমালের আঁচ পেতেই ঠাকুমার বাড়ির বহু পুরনো চাকর নিতাই দৌড়ে গিয়ে পুলিসের হাতে পায়ে না পড়লে আর বৃষ্টিতে ভিজে খড় আগুন ধরতে সময় না লাগলে, সেদিন ঋদ্ধির অর্দ্ধনগ্ন, হাত পা ঝলসে যাওয়া, অচৈতন্য দেহটির স্থান হত কোনও মর্গে।

দেহের ক্ষত শুকোতে লেগেছিল মাস খানেক। আর মনের ক্ষত…?

বার্কলের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যলিফোর্ণিয়ার জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সিনিয়ার প্রফেসর ডঃ ঋদ্ধি গুপ্ত কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে জানলার বাইরে তাকান। গ্রিজলি পার্কের এই ক্যাফে কর্নারটি তাঁর প্রিয় জায়গা। এটি তাঁর নিজের সাথে সময় কাটানোর গুপ্ত কুঠুরিও বলা যায়। গবেষণা ও তা শেষে অধ্যাপনা, নয় নয় করে কতগুলো বছর কেটে গেল এই বিদেশ বিভুঁইয়ে। কৈশোর প্রান্তের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতা কি যেন এক চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে ওনার ওপর। এতগুলো বছরে তাই নানা মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়ালেও স্থায়ী হয়নি আজ অবধি কোনটাই। এখনও একটা নিঃসঙ্গ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন ঋদ্ধি। এখনও দুঃস্বপ্নের রাতে চমকে ওঠেন, মন খারাপের দিনে কানে বাজে তিনি পাপ, অপ্রকৃতিস্থ.. এত বড় পাপ যে তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতেও দ্বিধা করে না লোকে?

কোন অপরাধে সেই আঠেরো বছর বয়স থেকে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে? তার ভালবাসার গ্রাম থেকে, বাড়ি থেকে, শহর থেকে আর এখন দেশ থেকেও! তৃতীয় লিঙ্গের প্রতি এখনও এত অসহিষ্ণু কেন সারা বিশ্ব? তাঁদের বাড়ি ভাড়া দেওয়া যায় না, প্রতিবেশী হওয়া যায় না, স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখা অসম্ভব! মোহনপুর তো অজ গ্রাম ছিল, কেন এই প্রথম বিশ্বের অনেক লোকও একে মানসিক বিকৃতি মনে করে? জেনেটিক সায়েন্স এর এত গভীর অবধি গবেষণা করা অধ্যাপকও এর উত্তর খুঁজে পাননা।

তবে আজকের বিষণ্ণতা কিছুটা অন্যরকম। লাঞ্চের পরে মোবাইলে ঢোকা একটা মেসেজ।
‘সেদিন এম.আই.টি.তে ওয়ার্ল্ড সায়েন্স কনফারেন্সে তোর প্রেজেন্টেশনের পর অত বড় অডিটোরিয়াম যখন হাততালিতে ফেটে পড়ছিল, তখন ওই ২৫০০ মুগ্ধ শ্রোতার মাঝে এক আমি ভেতর থেকে থরথর করে কাঁপছিলাম। এতবছর বাদে এই অকস্মাৎ দেখা..সেদিন কিছু না করতে পারার গ্লানি আর তোর জন্য অসীম গর্বে। অনেক কষ্টে তোর নম্বর জোগাড় করেছি, আরও অনেক বেশী সাহস আর স্পর্ধা সঞ্চয় করে আজ মেসেজ করলাম। যদি উত্তর দিস বুঝব ক্ষমা করতে পেরেছিস… পিঙ্কি’

দুপুর থেকে অন্তত পাঁচশো বার পড়েছেন ঋদ্ধি মেসেজটা। এক নিমেষে তাঁর মনের গুপ্ত সিন্দুকটা ধরে নাড়া দিয়ে গেছে যেন। একটা বড় শ্বাস নিয়ে হাত নেড়ে ওয়েটারকে ডাকেন ঋদ্ধি। বৃষ্টিটা থেমেছে। ক্যাফে থেকে বেড়িয়ে আস্তে আস্তে ইউনিভার্সিটির দিকে হাঁটতে থাকেন অধ্যাপক ঋদ্ধি গুপ্ত। দূরের বিদেশী আকাশে তখন রামধনুর রেখা ফুটে উঠেছে।

Copyright © Kothabriksha 2022, All Rights Reserved

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.