রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার পথিকৃৎ – শ্রী শুভ গুহঠাকুরতা

তথ্যসংকলন ও অনুলিখন – প্রীতম চৌধুরী

শ্রী শুভ গুহঠাকুরতা।

জন্ম পূর্ববঙ্গের বরিশালে – ১৯১৮ সালের ১০ই জুলাই। মাত্র ছ-মাস বয়সে বাবাকে হারিয়ে, ছ-বছর বয়সে পরিবারের সাথে কলকাতায় চলে আসেন।  

হেয়ার স্কুলে পড়াশুনা। ১৯৩৪-৩৫ সালের কলকাতা শহর। উত্তর কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে থাকার সুবাদে, এবং দুই বন্ধু দিলীপ চট্টোপাধ্যায় ও বিথীন্দ্র গুপ্তের সাহচর্যে ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াতের সুযোগ হয় তাঁর। সেই উপাসনা, গভীর দাগ কাটে যুবক শুভ গুহ ঠাকুরতার মনে। সবচেয়ে বড় কথা, আচার্য হিসেবে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে দেখা এবং শোনা, এবং তৎকালীন সুধীসমাজের নানা মানুষের কথা ব্রাহ্মসমাজে শোনা, সেই যুবক মনে গভীর প্রভাব ফেলে। যা রবীন্দ্রনাথের গান ও রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকে এক অন্য আঙ্গিকে দেখতে শেখায় করে তাঁকে।

এর পর, অরুন্ধতী দেবীর অনুরোধে তিনি শান্তিনিকেতনে আচার্য শ্রী শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা আরম্ভ করেন। এই অনুরোধে আরেকজন সামিল ছিলেন, তিনি আর কেউ নন, তাঁর স্নেহের মোহরদি, অর্থাৎ শ্রীমতি কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।

আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে শিক্ষাকালে, এক অমূল্য সম্পদের হদিশ পান তিনি। বস্তুত, তখনও ‘স্বরবিতান’ বই প্রকাশ পায়নি। তাই, শান্তিনিকেতনে শিক্ষকরা যা শেখাতেন, শিক্ষার্থীরা তাই লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। এই ভাবে, নানা গানের নানা স্বরলিপি শুভ গুহ ঠাকুরতা লিখে রাখেন। পরে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বভারতী থেকে স্বরলিপি বই প্রকাশ পেলে, কিছু গানের সাথে সুরের সামান্য পার্থক্য দেখা যায়।  

কিন্তু এই সম্পদ তিনি কুক্ষিগত করে রাখতে চাননি। রবীন্দ্রনাথ নিজেও তাঁর জীবৎকালে তাঁর গানের প্রচার ও প্রসার দেখে যেতে পারেননি। তিনিও চেয়েছিলেন তাঁর গান ব্রাহ্মসমাজ ও শান্তিনিকেতনের গণ্ডি ছাড়িয়ে কলকাতা তথা সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ুক। সেই আদর্শ মাথায় রেখে, ১৯৪১ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ও ইন্দিরাদেবী চৌধুরানী-র অনুমতি নিয়ে, শুভ দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে “গীতবিতান” নামক সঙ্গীত শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। এবং পরবর্তীকালে, ১৯৪৮ সালের ৮ই মে, দেশপ্রিয় পার্কে তাঁর নিজের একার উদ্যোগে কেবলমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষায়তন হিসেবে “দক্ষিণী” প্রতিষ্ঠা করেন।

রেডিও তে সেসময় রবীন্দ্রনাথের গান – ‘রবিবাবুর গান’ হিসেবে লোকগান পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত ছিল। দক্ষিণীর কৃতি ছাত্র  শ্রী দেবাশিস রায়চৌধুরীর কথায় – “রবীন্দ্রনাথের গানকে রেডিও ও ব্রাহ্মসমাজ-শান্তিনিকেতনের বাইরে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে আনার অন্যতম পথিকৃৎ শুভ। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথের গান যে রীতিমতো শিক্ষার একটি বিষয় হতে পারে, এই ধারণা মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে এর আগে কেউ তুলে ধরেননি। তাঁর আমলেই আকাশবাণীতে দক্ষিণীকে এক ঘণ্টার slot দেওয়া হয়, যা আর কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পেত না। ”

তিনি যে সফল হয়েছিলেন, সংখ্যা তার কথা বলে। প্রথমে ১৯৪৮ সালে মাত্র ১২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হওয়া একটি প্রতিষ্ঠান ১৯৫৫ সালে মাত্র ৭ বছরে প্রায় ৬০০ জন শিক্ষার্থীকে রবীন্দ্রগানের শিক্ষাদান শুরু করে। সেই বছরের ১৬ই অক্টোবর, ১ দেশপ্রিয় পার্ক ওয়েস্ট, অর্থাৎ বর্তমান “দক্ষিণী ভবন” – এ ক্লাস শুরু হয় এবং সুবিনয় রায়, সুচিত্রা মিত্র, সুনীল কুমার রায়, কমলা বসু প্রমুখ ছিলেন প্রথম দিকের শিক্ষক।

নিজেকে আজীবন শিক্ষক ভেবে এসেছিলেন শুভ গুহ ঠাকুরতা। কেমন ছিল তাঁর শিক্ষণ-পদ্ধতি? দেবাশিসবাবু আরও জানাচ্ছেন, “কঠিন তাল-সুরের গান সহজ ভাবে শেখাতেন। অর্থাৎ, ফার্স্ট ইয়ারের এক শিক্ষার্থীও সহজে সুরফাক্তা বা চৌতালে নিবদ্ধ কোনো ধ্রুপদ অনায়াসে শিখে নিতে পারতেন। এ এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। কিন্তু performance এর প্রতি কোনদিনই ঝোঁক ছিল না তাঁর। বলতেন – ‘গান হ্যাংলামো করবে না। কে কোথায় গাইল কটা গান গাইল এসব দিকে নজর দেবে না।’ রবীন্দ্রনাথের অশ্রুত ও অল্পশ্রুত গানের প্রচার এক সঙ্কল্প ছিল তাঁর। রবীন্দ্রনাথের সাংগীতিক সম্পদ ১৫০-২০০ গানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাননি কখনোই।”

বাংলার শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সমাজে, সে সময় রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে কিছু ধারণা প্রচলিত ছিল, যে রবীন্দ্রসঙ্গীত সেই দরের নয়। কারণ, গীতবিতান গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ কেবল কাব্যধর্মী পর্যায়ে তাঁর গানসমুহ বিভক্ত করেন। এই ধারণা ভাঙতে তিনি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে কলকাতায় তিন দিন ব্যাপী All India Rabindrasangeet Conference এর আয়োজন করেন, এবং তাতে দেখিয়ে দেন – কাব্যধর্মী রাবিন্দ্রিক গান ছাড়াও রবীন্দ্রসঙ্গীতে ধ্রুপদ, ধামার, টপ্পা, খেয়াল, ঠুংরি ইত্যাদির প্রভূত উদাহরণ রয়েছে। সেই আলোচনায় আলোচিত রবীন্দ্রগানের বিষয় ভিত্তিক পর্যালোচনা তাঁর রচিত গ্রন্থ “রবীন্দ্রসঙ্গীতের ধারা” বইতে স্থান পায়। যেখানে তিনি রবীন্দ্রনাথের গানকে গীতধর্মী ও কাব্যধর্মী বিষয় অনুযায়ী ১৭টি উপপর্যায়ে বিভক্ত করেন। যা পরবর্তীকালে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিষয়ভিত্তিক গবেষণায় উল্লেখযোগ্য দলিল হয়ে দাঁড়ায় । প্রসঙ্গত, সেই বইয়ের প্রচ্ছদ রচনা করেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।

বর্তমানে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনুমোদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগে, রবীন্দ্রগানের সেই ১৭টি পর্যায়-ই অনুসৃত হয়েছে।  

এছাড়াও, ১৯৬১ সালে, সারা দেশপ্রিয় পার্ক ঘিরে প্রায় ২২ দিন ব্যাপী রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান করেন, যেখানে নানা শিল্পী রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশন করেন। এই অনুষ্ঠান, রবীন্দ্রচর্চায় দক্ষিণীকে এক অন্য পরিচিতি দান করে।    

দক্ষিণীর আরেক কৃতি ছাত্র শেখর গুপ্ত, একই বিষয় জানান আমাদের – “শিক্ষণের পাশাপাশি নিয়মানুবর্তীতার প্রতি তাঁর অসীম অনুরাগ ছিল। স্কুলের প্রতি ছাত্রছাত্রীকে চিনতেন এবং ক্লাস চলাকালীন দোতলা- তিনতলার বারান্দায় পায়চারি করতেন ক্লাস ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা তা দেখার জন্য। অসম্ভব নিয়মানুবর্তিতা। সন্ধ্যে ৭টা মানে ৭টা, তাতে কোন এদিক ওদিক হওয়ার জো ছিল না। কোনদিনই জনসমক্ষে গান করেননি সেভাবে, শুধু একবার সম্ভবত ওঁর শিক্ষক জীবনের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে ‘দিন যায় রে’ গানটি গেয়েছিলেন সকলের অনুরোধে।”

শুধু রবীন্দ্রনাথের গানের সামগ্রিক প্রচার ও প্রসার নয়, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষণকে সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে এক বিষয় হিসেবে তুলে ধরা – এই কাজের এক নিঃশব্দ pioneer ছিলেন শ্রী শুভ গুহ ঠাকুরতা।

আজ তাঁর তৈরি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান “দক্ষিণী” – শ্রী সুদেব গুহঠাকুরতার অধক্ষ্যতায় – তার নিয়মানুবর্তিতা, তার শিক্ষণ-শৈলী এবং সর্বোপরি শিক্ষার্থীদের মনে বিশুদ্ধ রবীন্দ্রচর্চা ও চর্যার বীজ বপন করার যে কাজ শুরু করেছিল, ৭৫ বছর পর একটি আজও একই ভাবে করে চলেছে। আজ ১০ই জুলাই, শ্রী শুভ গুহ ঠাকুরতার ১০৪ তম জন্মদিবসে তাঁকে আমরা সশ্রদ্ধ স্মরণ করি।

কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ শ্রী সুদেব গুহ ঠাকুরতা, অধ্যক্ষ, দক্ষিণীশ্রী দেবাশিস রায় চৌধুরী, শ্রী শেখর গুপ্ত, প্রত্যয় রাহা, নীলিমেশ রায়, দীপাঞ্জন পাল।

Copyright © Kothabriksha 2022 , All Rights Reserved

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.