সে এক মেঘ পাহাড়ের গল্প – শ্রাবন্তী সেন

এক পুঞ্জ মেঘ এসে জমেছিল পাহাড়ের গায়ে। বড় ক্লান্ত ও বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল তাকে। কোথায় তার সেই রাজহাঁসের মত ধবধবে জৌলুশ, পেঁজা তুলোর পেলবতা, আকাশের বুকে দৃপ্ত বিচরণ আজ ম্লান। পাহাড় শুধোয়, ‘কি গো, এদেশ, ওদেশ ঘুরে ঘুরে বেড়ালে, নাহয় কিছু খুশিই বয়ে আনতে আমার জন্য? তোমায় ভারি হিংসে হয় গো – কত কিছু দেখ, কত জায়গা, রকমারী বাড়ি, গাড়ি, মানুষ…..’, কেমন জানি থমকে যায় পাহাড় কথার মাঝেই।

‘তা যা বলেছ,’ কিছুটা যেন রোদের রেখা মেঘের মুখে, ‘কত জায়গাই তো ঘুরি। বিচিত্র তাদের রূপ, কত না তাদের রঙ, রস, গন্ধ। এই তো সেদিন, কুয়াশার হাত ধরে এক সকালে ঘিরে ধরেছিলাম তোমারি মত এক পাহাড়ের রাস্তাকে। আর ব্যস, দিনের আলোতেই মানুষগুলোর চোখে অন্ধকার দেখার জোগাড়! গাড়িগুলো সকালবেলা চলেছে লাইট জালিয়ে… সে ভারী মজার ব্যাপার..!’ মেঘ খিলখিলিয়ে ছড়িয়ে পড়ে পাহাড়ের চারধারে।

‘আবার আরেকদিন, বাড়ির জানলা খোলা পেয়ে ভাসতে ভাসতে ঢুকে পড়েছিলাম একেবারে ঘরের ভিতরে। একটা কি সুন্দর ছোট্ট মানুষ খেলে বেড়াচ্ছিল ঘরের মধ্যে। যেই তার কাছে যেতে যাব ওমনি কোথা থেকে ওর মা ছুটে এসে কোলে তুলে নিয়েছিল তাকে। ‘আরে ছেলের ঠান্ডা লেগে যাবে তো.. জানলাটা বন্ধ কর..’, এই কথা শুনে না আমার মনটাও কেমন যেন ভিজে উঠেছিল, আশেপাশের সব কিছু ভিজিয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল। আচ্ছা, আমাদের কি ইচ্ছে থাকতে নেই?’

‘এই তোমার এক দোষ,’ পাহাড়ের গলায় মৃদু অনুযোগ, ‘কথায় কথায় শুধু ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে জল ঝরাবে..!’
মেঘ লজ্জা পেয়ে গুটিসুটি মেরে পাহাড়ের কোলে। এক বিশাল নিশ্চিন্ত আশ্রয় এটা তার।

‘তবে আমার সবথেকে প্রিয় কি বল তো?’ মেঘের আজ কথার ফুলঝুরি। ‘লম্বা লম্বা পাইন গাছগুলির ফাঁকে ফাঁকে রোদের সাথে লুকোচুরি খেলা!’
‘আর, তোমার কোনে কোনে যে পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো? আমার ঝরানো বর্ষার জল পেয়ে যারা উদ্দাম, চঞ্চল? বড় বড় পাথরের ওপর তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তারপর তার কাঁচের মত স্বচ্ছ জল তিরতির করে বয়ে চলেছে হারিয়ে যাওয়ার উদ্দেশে, সেই ঝর্ণার উদ্দামতার সাথে একাত্ম হয়ে যাই কোথাও, কখনও যেন’। ভাললাগায়, ভালবাসায় মেশা এক অস্ফুট স্বরে মেঘ বলে চলে, ‘আমাদের সেই মিলনের রঙ কেমন জলের ওপরে রামধনু হয়ে ফুটে ওঠে তুমি দেখেছ? তবে সেও তো ক্ষণিকের মুহূর্ত মাত্র, আমার আর বেঁধে থাকার উপায় হল কই?’

‘হুম। তা তো বুঝলাম। তাহলে ছুটে ছুটে এই বুড়োর কাছে আসা হয় কেন?’ পাহাড়ের গলায় স্নেহের প্রশ্রয়।

‘কে বলে তুমি বুড়ো?’ কলকলিয়ে প্রতিবাদ করে মেঘ। ‘তুমি তো আদি, তুমি অনন্ত। তোমার বিশালতা দিয়ে কেমন আগলে রেখেছ আমাদের, এই গোটা পৃথিবীটাকে? যুগ যুগান্ত ধরে। তুমি না থাকলে আমাদের অস্তিত্ব থাকত?’ এক নিঃশ্বাসে কথা কটা বলে দম নেয় মেঘ।
‘জানো, রাতে যখন জগৎ সংসার ঘুমোয়, আমার তো ঘুম নেই, আমি চুপ করে বসে বসে শুনি তোমার মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো কেমন ঝিরঝিরে ভাষায় কথা বলে নিজেদের মধ্যে, লতানো অর্কিড আগলে রাখে পাখিদের বাসা, আশ্বাস দেয় নির্ভরতার, কট্কটি পোকাগুলো একসাথে কটর কটর করে আড্ডা জমায় – কেউ আবার করাত চালানোর মত আওয়াজ তোলে – যেন সারাদিনে আশে পাশে যত শব্দ শুনেছে সব মিলিয়ে তান সাধতে বসেছে। ঝিঁঝিঁর ডাক, রাত জাগা পাখির টিঁ টিঁ – এসবের মাঝে তোমার নীরবতার শব্দ এক অদ্ভুত রোমান্টিক ভাষা খুঁজে পায়।
তবে? তোমার মত সুঠাম সুন্দর প্রেমিক আর আছে নাকি? তাই তো অস্থির লাগে যখন বার বার ছুটে ছুটে আসি গো তোমার কাছে একটু স্বস্তির আশ্রয়ের জন্য’।

‘আমার আর সেই শক্তি নেই গো… আমাকে ওরা চারদিক দিয়ে ভেঙ্গে দিচ্ছে, গুঁড়িয়ে যাচ্ছে আমার শরীর’। পাহাড়ের হঠাৎই প্রায় আর্তনাদে চমকে ওঠে মেঘ, শান্ত সমাধিস্থ পাহাড়কে এরকম উত্তেজিত দেখে।

‘কি হল গো আজ তোমার? তুমি তো এমন কর না…’

‘সভ্যতা এগোচ্ছে মেঘ, দেখতে পারছ না? আমার একটা জমিও খালি নেই। বাড়ি, হোটেল, হোম স্টে… আর জমি খালি না পেলে, খালি করে নেওয়া। গাছ কেটে, নদী আটকে। পর পর গাড়ীর ধোঁয়ায় আমার যে দম বন্ধ হয়ে যায় গো আজকাল’।

‘বুঝেছি’, মেঘ আরও একটু সরে আসে পাহাড়ের দিকে, ‘আমারও তো একই কারনে মন খারাপ। আমার চেহারা দেখেছ? কালো ধোঁয়া, দূষিত ধুলো, বিষাক্ত গ্যাস এসব হাওয়ায় ভেসে এসে আমার কি অবস্থা করে দেখছ না? আমার আসল বর্ণ তো ভুলতেই বসেছি প্রায়’।

‘আমি মানুষ খুব ভালবাসতাম জানো তো মেঘ’, পাহাড় বলে, ‘আমি তো এক জায়গায় স্থবির। কত দূর দূরান্ত থেকে, কত সব জায়গা থেকে মানুষ আসে, কত রকম তাদের ভাষা, পোশাক, আচার ব্যবহার, তারা দল বেঁধে বেরাতে আসে। কত রকম কথা শুনি তাদের থেকে, তাদের জীবনের একএকটা টুকরো যেন ফুটে ওঠে ক্যানভাসের ছবির মত ওই কদিনে। আমি না তাই আমার বুক পেতে দিয়েছিলাম, ওদের থাকা, ঘোরার ব্যবস্থা করতে।

কিন্তু ওরা কি করল? দিনে দিনে চেপে বসতে থাকল। হোটেলের পর আরও হোটেল, আরও চওড়া রাস্তা, বড় রেস্তোরাঁ, দোকান.. অগুনতি লোক, অসংখ্য গাড়ী, বাড়তে থাকা চাহিদা…’, পাহাড় হাঁফায় একটানা বলে, ‘মাঝখান থেকে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত প্রায়, আর যেন ভার বহন করতে পারছি না!’

‘কিন্তু তোমার কাছে যারা থাকে? এখানেই যাদের বাড়ি? তারা কিছু বলেনা?’

‘তারা কি বলবে? তারাও তো এই দৌঁড়ে সামিল। আগে এরকম ছিল না ওরা জান তো? সহজ সরল মানুষগুলো এখানকার। বৈভব নেই কিন্তু মনের প্রাচুর্যে ভরপুর। সারাদিন পরিশ্রমের পর আত্মীয়, বন্ধু, পরিবারের সাথে গান, বাজনা, আনন্দ- গানের কথা, সুরের মধ্যেও যেন এখানকার মাটি, হাওয়া, পাহাড়, ফুলের গন্ধ। প্রকৃতি যেন আরাধ্য দেবতার মতই সমাহিত ওদের কাছে। কিন্তু এখন?’ পাহাড় দম নেয় এক মুহূর্ত।

‘অবশ্য ওদেরই বা পুরোপুরি দোষ দিই কিকরে বল? বাইরের থেকে মানুষ এলে যে এদের কিছু আয়ের সংস্থান হয়, কষ্ট করে টেনে চলা সংসার অল্প সুখের মুখ দেখে তা কি আর বুঝি না আমি? তাই তো রাগ করতে গিয়েও পারি না যখন দেখি হোম স্টের হুজুগে এখন সবাই তাদের বাড়িকে অতিথিশালা বানিয়ে ফেলছে। তাতেও আপত্তি ছিল না জান তো? কিন্তু এই যে প্রচুর পরিমাণ পর্যটকের আগমন আর তাদের আরামদায়ক সুবিধার্তে লাগামছাড়া জালানির ব্যবহার, জমতে থাকা বর্জ্য পদার্থের দায়সারা নিষ্পত্তি, সঠিক নিষ্কাশন ব্যবস্থার প্রতি অবহেলা আর বিপুল পরিমাণে গাড়ী চলাচল বৃদ্ধি – এতে যে আমার প্রাণ যেতে বসেছে! আমার বাঁ দিকে ওই কোণটা দেখ মেঘ… মনে পড়ে কত সবুজ ছিল… আর এখন দেখ…’

পাহাড়ের কথায় প্রায় ফাঁকা হয়ে যাওয়া একটি বনাঞ্চলের দিকে নজর পড়ে মেঘের,
‘মানুষের এত বুদ্ধি কিন্তু লোভ যে বড় সাংঘাতিক! এত জানে তারা, এত যাদের জ্ঞানের গর্ব, তারা এটুকু বোঝে না যে কি বিপুল ক্ষতি তারা নিজেদের করে চলেছে? পরিবেশ ঠিক না থাকলে যে তারা শারীরিক, মানসিক কোনদিকেই ভাল থাকবে না এটা না বোঝার মত অজ্ঞ তো তারা নয়। তবে?’

‘এটা তো আমারও প্রশ্ন। মানুষ যদি এতই পাহাড় প্রেমী, পর্যটন প্রিয় হয় তবে প্রিয় জিনিসের যত্নটুকু করতে পারে না কেন বলতে পার? কেন বেড়াতে এসে বিস্কিট, চিপসের র‍্যাপার, জলের বোতল আর প্লাস্টিকের স্তুপে তার নিদর্শন রেখে যায়? জান, আমাদের সবার জেষ্ঠ শৃঙ্গ, সাধারণের অগম্য, অত দুর্গম মাউন্ট এভারেস্ট পৃথিবীর বৃহত্তম আবর্জনাগারে পরিণত হচ্ছে? মানুষের ট্রাফিক জ্যাম লাগে সেখানে!’

কথার মাঝখানেই গুরু গুরু শব্দে ভূমিকম্পের মত কেঁপে ওঠে পাহাড়! বিশাল বুলডোজার তখন হিংস্র আঘাতে জরাজীর্ণ করছে তাকে… পাহাড়, নদী ভেদ করে বসছে ট্রেনের লাইন, নদীর স্রোত আটকে তৈরি হচ্ছে বিদ্যুৎ, আরও এগোচ্ছে সভ্যতা, আরও আরও আরাম চাই মানুষের, আরও অনেক বেশী মানুষের পায়ের চাপে দলিত নিষ্পেষিত হতে থাকে মাটি।

দুর্নিবার শঙ্কায় কাঁপতে থাকে পাহাড়, দূষণের জলভার অসহ্য হয় মেঘের, হাওয়ায় ধুলোর ঝড় ওঠে, মাটির বাঁধন আলগা হতে থাকে, আকাশ চিরে নেমে আসে মন খারাপের অভিশাপ। কেদারনাথ, অমরনাথ, অসম, মণিপুর – খড়কুটোর মত ভেসে যায় মানুষের ঔদ্ধত্য, সভ্যতার অহং।

Copyright © Kothabriksha 2022, All Rights Reserved.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.