গানের খোঁজ, নতুন সুরের খোঁজ এবং সেগুলো নিয়ে চর্চা/পড়াশোনা আমাদের কে নিত্য নতুন কর্মকান্ড ও সারা পৃথিবীর সঙ্গীত কর্মযজ্ঞে সামিল হওয়ার রাস্তা দেখায়। এই সামিল হওয়ার রাস্তা গুলির মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রাস্তা হলো নিজের দেশের, নিজের মাটির সঙ্গীত এর উৎস ও তার সাথে সমাজের সম্পর্ক নিয়ে চর্চা, বিভিন্ন ধরণের আলোচনা ও নিবিড় অনুসন্ধান।
একটা গানের চলন যে একটা সভ্যতার ইতিহাস জানার চাবিকাঠি হতে পারে, সেটা কোনোদিন ভাবিনি।
‘হস্তির নড়ান হস্তির চড়ান
হস্তির গলায় দড়ি
ওরে সত্য করিয়া কনরে মাহুত কোনবা
দ্যাশে বাড়িরে।
ও তোমরা গিলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে
ও তোমরা গিলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধুরে।’
গানটি প্রথম যাঁর কণ্ঠে শুনি তিনি ভারতের ক্ষণজন্মা মহান গুনী লোকগীতি শিল্পী শ্রদ্ধেয় প্রতিমা বড়ুয়া।
হাতির চলার ছন্দ আর এই গানের ছন্দে কি হুবুহু মিল। তাহলে কি হাতির চলার ছন্দেই এই গান বাঁধা হয়েছিল? তাহলে কি হাতির পিঠে বসেই এই ছন্দ অনুভব করে সেই ছন্দে গান তৈরি করার কথা ভাবা হয়েছিল? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েই প্রতিমা বড়ুয়া, হাতিধরা গান নিয়ে একটু পড়াশোনা শুরু করলাম। এই সব কথা গল্প গান নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে দেখলাম যে এক অনন্ত সাগরে ঝাঁপ দিয়েছি, মানে যাকে বলে প্যান্ডোরা’স বক্স। একই ছন্দে আর একটা গানের কথা বলি,
‘বাঁধিছেন ঘর মিছা,
মিছায় দ্বন্ধ মাঝে গো সাঁইজি
কোন রঙ্গে।
ও দিনে দিনে খসিয়া পড়িবে
রঙ্গিলা দালানের মাটি গো সাঁইজী …
কোন রঙ্গে।’ যদিও এই গানটি হাতি ধরা গান নয় তবে চলন এবং ছন্দে ঠিক একই রকম গন্ধ আছে।
গানটি মূলত ভারতের আসাম অঞ্চলের একটি লোকগান। গানের গীতিকার প্রখ্যাত সাধক কবি নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায়। গানটির মূলশিল্পী প্রতিমা বড়ুয়া। একটা গান কে প্রাতিষ্ঠানিক গন্ডির বাইরে গানের সুর তাল লয় এর বাইরেও কতটা বড় আবেগের আশ্রয় তৈরি করা যায়, কতটা প্রাণ সঞ্চার করা যায়, কিভাবে একটা সভ্যতার ছবি আঁকা যায়, খুব যত্ন নিয়ে দেখিয়েছেন প্রতিমা। তাই তো এখনো প্রতিনিয়ত ওনার গানের কাছে ফিরে যেতে হয়। আরো কত গান মনে পড়ছে, ‘হস্তীর কন্যা হস্তীর কন্যা বামনের নারী, মাথায় নিয়ে তাম কলসী ও’, মাহুত বন্ধুর গান, জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে গান।
বৃহত্তর উত্তরবাংলা ও নিম্ন অসমের লোকজীবনে ‘হাতি’ ছিল একসময় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাহন। অরণ্যের কাষ্ঠ আনয়ন, রাজা-জমিদার-দেওনিয়া দের শাসনকার্য পরিচালনায়, দেশীয় মহারাজাদের রাজকার্য পরিচালনা, শিকারযাত্রা, বিনোদন ইত্যাদি কাজকর্মে হাতি ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান।
ফাঁস, খেদা ও আরো নানা ভাবে জংলি হিংস্র হাতিকে ধরা হত বন-বনাঞ্চল থেকে, কুনকী(প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হাতি), মাহুত, ফান্দি ও দফাদারদের সহায়তায়। এরপর শুরু হত নানা উপায়ে অশান্ত ভয়ানক জংলি হাতিকে পোষ মানিয়ে সামাজিক কর্মযজ্ঞে উপযোগী সহনশীল করে তোলার প্রচেষ্টা।
এইভাবে তৈরি হলো এক নতুন ধরনের লোকসংস্কৃতির ধারা ‘হাতি ধরার গান’ বা ‘হাতিগান’। গানের সাথে যুক্ত হলো বিভিন্ন ধরণের নৃত্যভঙ্গি। নাচের ধারা তো ছিলোই, তার সাথে চলতো নানা ধরণের লোকায়ত বাদ্যযন্ত্রের একটা যুগলবন্দী। এই ভাবেই শান্ত হত সেই হাতি। লোকায়ত রাজবংশী ভাষায় গান তৈরি হতো, জীবনযাপন, জীবনচর্যার ও সমকালীন সভ্যতার নানাবিধ রূপ ধরা পড়তো সেই গানে। কিন্তু মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও সময়ের সাথে সাথে বিশ্বায়ন শিকড় বিচ্ছিন্নতা লোকায়ত ভাষাগুলির ওপর এক গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই ভাবে লোকসংস্কৃতির অনেক ধারারই বর্তমানে অবলুপ্তি ঘটেছে, প্রতিপলেই ঘটছে।
যে গানের বিষয়ে কথা বলছিলাম, তার সাথে যে সঙ্গীতের বিশেষ ধারা জড়িয়ে আছে, তা হলো ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়া নিয়ে পরের দিন চেষ্টা করবো কিছু আলোচনা করার। এই মাহুত বন্ধুর গান, হাতি ধরার গান, বিরুয়া গান, হাতিশিকারের গান, হাতিপ্রশিক্ষণ এর গান নিয়ে আরো অনেক তথ্য আছে দর্শন আছে, এই লোকসংস্কৃতির ধারা কে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কর্তব্য। আজ ভীষণ জরুরি শিকড়সন্ধান। লোকায়ত সংস্কৃতির নিবিড় চর্চা ও অনুসন্ধান।
ছবি ঋণ – জয়িতা রাহা