বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী শ্রী প্রবুদ্ধ রাহা-র সাথে রবীন্দ্রগানের একটা বিশেষ আঙ্গিক নিয়ে একটি সাক্ষাৎকার করলেন ওনারই পুত্র প্রত্যয়।
প্রশ্ন : আমরা জানি যে রবীন্দ্রনাথের গানের একাধিক বৈশিষ্ট্য আছে, তবু এতো বছর এই বিষয় টা নিয়ে চর্চার পর, যদি জানতে চাই কোন জায়গা টা তোমায় অন্যরকম ভাবে স্পর্শ করেছে, এবং তোমার মনে হয়েছে যে এই ব্যাপার টা নিয়ে তেমন কথা আলোচনা হয়নি, তাহলে সেটা কী হবে?
উত্তর : রবীন্দ্রনাথের গানের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বলা টা খুব কঠিন, কারণ এই গানের মধ্যে যত গুলি মিউজিকাল এলিমেন্ট আছে, প্রত্যেকটিই খুব উচ্চ মানের। কথা সুর ছন্দ সব কিছু কে নিয়েই আলাদা করে আলোচনা হতে পারে। গানের কথা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে, আমি সেই দিক টা খুব একটা যাবো না, বিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে কমন সেন্স এবং কিছুটা নিজের পড়াশোনা দিয়ে যতটা সাহিত্যের স্বাদ পাওয়া যায়, ততটাই আমি পেয়েছি এবং প্রতি নিয়ত পেতেই থাকি। যেটা নিয়ে অনেক দিন ধরে মনে হয়েছে, সেটা নিয়ে একটু বলার চেষ্টা করছি। রবীন্দ্রনাথের গানের সঞ্চারী। রবীন্দ্রনাথের গান তো একটা ছবি, একটা গল্প, মানে যেভাবে তুই দেখতে চাইবি, তো আমার মনে হয় সঞ্চারী টা ওই গল্পের মধ্যে আর একটা আলাদা গল্প, বা ওই ছবিটার মধ্যে আর একটা ছবি। এবং রবীন্দ্রনাথ প্রথম সঞ্চারী কে এই ভাবে মেইনস্ট্রিম গানে নিয়ে এলেন। আগেও কিছু কিছু গানে পাওয়া যায় কিন্তু এই ধরণের গানের চলন বদলে দেওয়া ভাবনা চিন্তা আগে হয়নি। মানে একটা অন্য গল্প তৈরি হচ্ছে।
প্রশ্ন : তুমি গল্পের দিক টা বলছো, কিছু সঞ্চারীতে তো সুরেরও একটা অদ্ভুত change আসে!
উত্তর : হ্যাঁ সে তো বটেই! সুরের ধরণ টাই অনেক গানে সঞ্চারীতে এসে একটা অন্য রকম বাঁক নেয়, সেটার কারণ টাই হলো এই যে উনি সঞ্চারীর কথাটা একটু অন্য ভাবে দেখাতে চেয়েছিলেন বলে আমার মনে হয়। কত গান আছে, বলে শেষ করা যাবেনা, ‘আমার একটি কথা’ এই গান টায় কল্পনা শক্তি কোন জায়গায় গেছে দেখ। আমাদের সৃষ্টিশীলতা কত দূর যেতে পারে? ওই ভদ্রলোকের imagination টা সাধারণ মানুষের থেকে একশত যোজন এগিয়ে থাকতো, আজও আছে। মানে সাধারণ মানুষ যখন চাঁদে পৌঁছে আনন্দ করছে, তখন উনি পরের গ্যালাক্সি তে পৌঁছে গেছেন।
প্রশ্ন : (হাসি) ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়, গান টার ব্যাপারে কী বলছিলে?
উত্তর : আমরা তো সকলে আকাশ দেখি, আকাশ দেখতে ভালোবাসি, তারা ভরা আকাশ দেখি। ‘আমার একটি কথার’ সঞ্চারী টা দেখ, ‘আমার চোখে ঘুম ছিলনা, গভীর রাতে, চেয়েছিলেম চেয়ে থাকা তারার সাথে’, আমরা তো তারা দেখি কিন্তু কখনো কি ভাবি যে সেই তারাও আমায় দেখছে? বা আমি যেভাবে দেখছি, তারাও সেইভাবে দেখছে সব কিছু, আমরা কি ভাবি?
প্রশ্ন : সত্যি সাংঘাতিক, সুরের চলনে কি কোনো পরিবর্তন হচ্ছে?
উত্তর : হ্যাঁ সেটাই বলছি, চোখের জায়গা টায় প্রথম শুদ্ধ নিখাদ টা উনি ব্যবহার করলেন, যেটা প্রথম থেকে গান টায় আসেনি। ওই ভাবে শুদ্ধ নিখাদ টা চন্দ্রকোষ রাগে ব্যবহার হয়, কিন্তু চন্দ্রকোষের ছোঁয়া কেন নিলেন? কারণ ওটা গভীর রাতের রাগ আর গভীর রাতে তারা দের সব চেয়ে স্পষ্ট দেখা যায়। গানটার স্থায়ী এবং অন্তরায় কিন্তু চন্দ্রকোষের কোনো ছোঁয়া দেখতে পাওয়া যায়না, সঞ্চারীতে এসে যেন একটা হঠাৎ নতুন রাস্তা।
প্রশ্ন : এখন প্রশ্ন হলো, রবীন্দ্রনাথের একদম প্রথম দিকের সৃষ্টিতে তো সঞ্চারীকে এতটা গুরুত্ব উনি দেননি, বা অনেক গানে সঞ্চারী নেই, যত সময় গেছে এই জিনিস গুলো ওনার composition এ এসেছে, তাহলে আমার বক্তব্য যে উনিও ওই Creative Process এর মধ্যে দিয়ে গেছেন?
উত্তর : হ্যাঁ অবশ্যই। প্রথম দিকে উনি সরাসরি কোনো একটা Form of Music থেকে নিয়ে গান বেঁধেছেন, যেমন খেয়ালের বন্দিশ ভেঙে এত গান, সেগুলোর বেশির ভাগই বন্দিশের ধরণেই কথা টা লেখা। স্থায়ী আর একটা অন্তরা, যেমন ‘রাখো রাখো রে’ গানটা সেইভাবে লেখা। সেই ক্ষেত্রে উনি তখন পুরো দমে পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। পরে ধীরে ধীরে যখন সারা পৃথিবীর Music ভেতরে নিচ্ছেন, তখন সেই সমস্ত দর্শন, সমস্ত form of music মিলেমিশে যেই সঙ্গীত তৈরি হতে শুরু করলো তা একেবারে অনন্য ও স্বকীয়।
প্রশ্ন : আর কোনো গানের কথা মনে হচ্ছে?
উত্তর : অনেক গান আছে, যেমন ‘তুমি কি কেবলই ছবি’। সঞ্চারী টা দেখ, ‘নয়নে সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই’, একজন মানুষ physically না থাকলেও আমাদের ভেতরে তাদের অস্তিত্ব থেকেই যায়। এখানে সুর টাও একটু বদলে যাচ্ছে, যদিও Drastic কোনো change নয়, তবু সূক্ষ্ম ভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাবে যে কিছু একটা বদলে গেল।
একই দর্শন, ‘চোখের আলোয়ে দেখেছিলেম চোখের বাহিরে’, সঞ্চারী তে এসে অদ্ভুত বাঁক, ‘তোমায় নিয়ে খেলেছিলেম খেলার ঘরেতে, খেলার পুতুল ভেঙে গেছে, প্রলয় ঝড়েতে’ , এরকম অনেক গান আছে।
প্রশ্ন : ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর’ গানটার সঞ্চারী এক অসাধারণ অভিব্যক্তি, তাই না?
উত্তর : ‘তাই তো তুমি রাজার রাজা হয়ে, তবু আমার হৃদয় লাগি, ফিরছো কতো মনোহরণ বেশে প্রভু নিত্য আছো জাগি’, আর একটা গানের কথা মনে হচ্ছে, ‘তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে’, সেটার সঞ্চারীতে এসে, ‘বসন্ত আজ উচ্ছ্বাসে নিশ্বাসে, এলো আমার বাতায়নে’, এই যে বাতায়নে টা এসে শুদ্ধ রেখাবে দাঁড়ালো, এইটা গান টাকেই অন্য মাত্রা দিয়ে দিলো, কারণ তার আগে অবধি কোমল রেখাব ব্যবহার হচ্ছিল। তারপর ‘কোলাহল তো বারণ হলো’ এই গানটার সঞ্চারীতে ‘মোর কাননে অকালে ফুল উঠুক তবে মুঞ্জরিয়া, মধ্যদিনে মৌমাছিরা বেড়াক মৃদু গুঞ্জরিয়া’, কোমল গান্ধার দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ মৃদু তে এসে একটা শুদ্ধ গান্ধার লাগলো, ব্যাপার টাই পুরো অন্য রকম হয়ে গেল। আর কথার দিক থেকেও ‘প্রানের আলাপ কেবল মাত্র গানে গানে’, এর সাথে উনি ফুলের চারপাশে ভ্রমরের গুঞ্জন কে এতো সুন্দর ভাবে মিলিয়েছেন, তার মধ্যে এত সুন্দর নৈঃশব্দ্য কে ধরেছেন যে সেখানেই গান টি পূর্ণতা পেয়েছে। ‘এতদিন যে বসেছিলেম’ গান টি তে সঞ্চারী একই ভাবে অন্য মাত্রা যোগ করে, একটা অন্য ছবি তৈরি করে, ‘গন্ধে উদাস হাওয়ার মতো, উড়ে তোমার উত্তরী, কর্ণে তোমার কৃষ্ণচূড়ার মঞ্জরী’, বলতে গেলে শেষ হবেনা।
প্রশ্ন : আচ্ছা উনি যখন কীর্তনের form টাকে নিয়ে এলেন নিজের গানে, পদাবলীর দর্শন টা আনলেন, প্রথম দিকে ভানুসিংহের গান বা ধরো ‘ওহে জীবনবল্লভ’ সেগুলোতে সঞ্চারী নেই, কিন্তু একই দর্শনে ‘এখনো তারে চোখে দেখিনি’ গানটিতে উনি সঞ্চারী এনেছেন, এই যে এতো ‘Experimentation’, এগুলোই কি ওনার সৃষ্টিশীলতাকে এতটা উন্নত করেছে?
উত্তর : Experimentation একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ factor, এ ছাড়াও আরো অনেকগুলো factor আছে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান কে ঠিক কোনো formula এ ফেলা যাবেনা, কোন সময় যে ওনার ভেতরে কোন জিনিসটা কাজ করে গেছে, এই ঠিক অঙ্ক দিয়ে মেলানো যাবেনা। যেমন ‘তোমরা যা বলো তাই বলো’ গানটির সঞ্চারী তে কোমল ধৈবত স্বর টি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে।
‘সে গান আমার লাগল যে গো, লাগল মনে, আমি কিসের মধু খুঁজে বেড়াই ভ্রমরগুঞ্জনে’, অনেক কিছু চলছে, পাগল হাওয়া চলছে আরো অনেক কিছু হচ্ছে, কিন্তু অনেক কিছুর মধ্যেও একটা ভ্রমরের গুঞ্জন সবচেয়ে বেশী করে মন কে ছুঁয়ে যাচ্ছে, এবং সেইটা এতো বড় Change, যে সেইটা বোঝাতে গিয়ে কোমল ধৈবত টা ব্যবহার করেছেন।
প্রশ্ন : দিনের শেষে এই ধরনের সঙ্গীত টা এতো কিছু নিয়ে একটা পূর্ণতা পেয়েছে, এবং গান হিসেবে individual elements কে ছাপিয়ে গিয়ে একটা পরিপূর্ণ সৃষ্টি আমরা পেয়েছি, সেটার কারণ তোমার কী মনে হয়?
উত্তর : আমার মনে হয় দুধরনের সৃষ্টি হতে পারে। এক, কোনো প্রয়োজনে সৃষ্টি করা, আর দুই, ভেতর থেকে আগ্নেয়গিরির থেকে ছিটকে আসা স্ফুলিঙ্গের মতো সৃষ্টি বেরিয়ে আসা। সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমার মনে হয় সেই স্বতঃস্ফূর্ততা যত বেশী থাকে তত ভালো, আর রবীন্দ্রনাথের গানে বা সৃষ্টি তে সেই ব্যাপার টা খুব অনুভব করি। তার মানে এই নয় যে যারা কোনো বিশেষ প্রয়োজনে গান লিখেছেন, তাদের টা উচ্চমানের হয়নি, সেরম একদমই নয়। পুজোর গান লিখতে হবে বলে অনেকে গান লিখেছেন, এবং সেই গান কালজয়ী গান হয়ে রয়ে গেছে। তাদের মধ্যে কোন গান টা স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আসা গান, আর কোন গান লিখতে হবে বলে লিখতে বসা, সেটা তো আমরা জানতে পারিনা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, creative process টার মধ্যে অনেক রকমের ওঠা পড়া থাকলেও, একটা অনেক বড় ক্যানভাস উনি দেখতে পেতেন বলে আমার বিশ্বাস, সেই ক্যানভাসে নিজের বুদ্ধি, বিবেচনা, সৃষ্টিশীলতা ও মনন কে তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অনন্তের সাথে মিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন।
Great insight. Osadharon kicchu perspectives pelaam.
LikeLike
সমৃদ্ধহলাম
LikeLike
Darun laglo. Anek kichu jante parlam.
LikeLike