কেন কাঁদাও – দিতিপ্রিয়া সরকার

“ মা,ও মা,আবার যে আমার জ্বর এলো…আর যে মাত্র তিনদিন বাকি!!!আবাসনের  মন্ডপে ঠাকুর এসে গেছে। আলো লাগানোও তো প্রায় শেষ।এবারও আমি পারবো না বেরোতে? ওমা”- কয়েক ফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়ে চোখের কোল বেয়ে। মা ঠান্ডা হাতটা রাখে জ্বরে পুড়ে যাওয়া কপালে,- “ লক্ষী মেয়ে,কাঁদেনা  মা। ডাক্তারজ্যেঠু তো ওষুধ  দিয়েছেন। দেখো ঠিক ভালো হয়ে যাবে। কাঁদলে আরও কষ্ট  হবে”। কপালে জলপটি দেওয়া চলে। চোখ বন্ধ করে থাকি। ছোটবেলা থেকে এভাবেই শুরু হতো আমার পূজো। প্রায় প্রতি বছর পূজোর আগে জ্বর। সেবারেও তাই। শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকি ঝকঝকে নীল আকাশটার দিকে। বল্লমের ফলার মত রোদ ঠিকরে বেরোচ্ছে। দেখতে দেখতে ষষ্ঠী পেরিয়ে সপ্তমী। সকাল থেকে জ্বর আসেনি। তবু বন্ধুরা ডাকতে এলে ফিরিয়ে দিই। বলি বিকেলে বেরোবো। ওরা অবাক হয়,- “ জ্বর তো নেই তোর,তবে বেরোবি না কেন? আয় না…” তবু যাই না। কেন যাই না তা শুধু আমি জানি।খুব গোপন সে কথা। কাউকে বলিনি। আমি জানি একসাথে বড়ো হতে হতে এই কিছুদিন আগেই যে বুঝতে পেরেছি সামনের বাড়ির দোতলার ওই রাগী রাগী ছেলেটাকে দেখতে পেলেই বুকের মধ্যে কেমন যেন করে!!! সামনে এসে দাঁড়ালে সমস্ত পৃথিবীটা যেন থেমে যায়। কথা বলা তো দূর চোখের দিকে তাকাতেও পারছি না,কিন্তু দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে…তাই তো এবছর পাড়ায় নাটক করার মেয়ে না জোটায় আমার দাদা যখন চুলের বিনুনিতে টান দিয়ে বলে “ এই, একটা পার্ট করবি নাটকে? কাউকে পাচ্ছি না”… দুবার ভাবিনা।কারণ জানি তো রিহার্সাল করতে গেলেই একবার করে দেখতে পাব সেই রাগী মুখটা। সেও যে আছে নাটকে এতো জানতাম।আর আজ বিকেলেই তো সেই নাটক। সকালে বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে আবার যদি জ্বর আসে? না না সে ঝুঁকি নেওয়া যাবে না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে।মন্ডপে আলো জ্বলে ওঠে।দাদা তাড়া লাগায় “ কিরে,চল্,ড্রেস মেকআপ করবি না?”…” এই তো আসছি”…..বলে  বেরোতে যাব,হঠাৎ মাইকে বেজে ওঠে “ যেতে যেতে পথে হল দেরী,তাই তো পারিনি,যেতে পারিনি….” আগে তো কতবার শুনেছি এ গান,এমন করে তো বুকে এসে সজোরে ধাক্কা মারেনি!!আমার পনেরো বছরের মনটা এমন করে তো ভিজে যায় নি আগে!! কি আছে ওই সুরটায়? কি আছে ওই গলাটায়? সবকিছু এত ভালো লাগছে কেন?ওই সুর,ওই কথা,ওই গলা আর আমার ওই গোপন ভালোলাগা মিলেমিশে যেন দলা পাকিয়ে ওঠে গলার কাছটায়,টনটন করে বুকের ভেতরটা।অবশ হয়ে যাই পঞ্চমের সুরের যাদুতে।সেই সুরই যেন টেনে নিয়ে যায় নাটকের মঞ্চের দিকে।

সেই থেকে আজও সেই মানুষটার সুরের নেশায় মাতাল হয়ে আছি।না,কখনও যেতে পারিনি সেই রাগী মুখটার কাছে।কিন্তু আজও আমার চল্লিশ পেরোনো আঙুলগুলো ছুঁতে চায় সেই পনেরো বছরের কিশোরীর আঙুলগুলো, যখনই কোথাও বেজে ওঠে “ যেতে যেতে পথে হল দেরী,তাই তো পারিনি,যেতে পারিনি”.….ভিজে ওঠে চোখ দুটো। কেন কাঁদাও পঞ্চম? কেন?

চিত্র ঋণ – সাধন মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.