১৯৮৯ সালের ডিসেম্বর মাস। সপ্তাহের গোড়াতে নরওয়ের ওসলো নগরী প্রবল শীতের মধ্যেও বেশ সাজুগুজু করেছে। চারিদিকে বরফ, ১০ ডিসেম্বর ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহের আসনে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা সুধীজনদের উপস্থিতিতে পূর্ণ। এখানেই গত ১৯৪৭ সাল থেকে ১০ ডিসেম্বর তারিখটি গুরুত্ব পেয়ে আসছে।মঞ্চে তাঁকে আহ্বান করার সঙ্গে সঙ্গে করতালি। করতালির মধ্যেই ৫ ফুট ৭ ইঞ্চির মানুষটি হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলেন….তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হল তাঁর প্রাপ্য সম্মান…তাঁর মুখের হাসিটিকে অম্লান রেখে পোডিয়ামে গিয়ে দাঁড়ালেন….তারপর…
“ভাই ও বোনেরা
আজ আমি আপনাদের দরবারে উপস্থিত হতে পেরে খুবই সম্মানিতবোধ করছি। এখানে নানা প্রান্ত থেকে আসা অনেক পুরানো বন্ধুদের দেখে ভালো লাগছে যেমন তেমনই নতুন বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে যাঁদের সঙ্গে ভবিষ্যতে কোথাও নিশ্চয়ই দেখা হবে।…” দীপ্ত কন্ঠে একথা বলতে বলতে তিনি সামান্য থামলেন। মুখে তাঁর তৃপ্তির হাসি। যেন জগৎ পারাবারের খেয়ার কান্ডারী। বলে চললেন…

“ জানেন, আমি যখনই যেখানেই কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা করি, আলাপ করি, তখন মনে হয় আমরা কিন্তু আসলে সকলেই একই রকম। সকলেই এক একজন মানুষ। হতে পারে আমাদের জামা কাপড় ভিন্ন, কিংবা গানের রঙও আলাদা, বা আমরা কথাও বলি ভিন্ন ভাষায়। সেটা আমাদের একটা অবস্থানমাত্র। কিন্তু আসলে আমরা সকলেই একই মানুষ।” একটানা এতটা বলার পর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। প্রেক্ষাগৃহের নৈঃশব্দতা তখন যেন আরো গভীর। তিনি কিন্তু নির্বিকার। অপলক দৃষ্টিতে উপস্থিত ভদ্রমন্ডলীদের দিকে চেয়ে আছেন। বললেন, “ এই মনুষ্যত্বই আমাদের প্রত্যেককে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে। আর ঠিক এই কারণেই আমরা একে অপরকে বুঝতে সহজ হয়, বন্ধুত্ব শুধু গড়ে ওঠে না, দৃঢ় হয়ে ওঠে।” সহজ সরল এই মানবসত্যের বাণী যে যুগ যুগ ধরে বয়ে আসছে মানুষের মনে, পরিবারে, দেশে বিদেশে তাই মানুষই মানুষের সমস্যা, দুঃখ, কষ্টকে বুঝতে পেরেছে। “এই পৃথিবীর বুকে আমরা একই সুরে বাঁচতে শিখি, শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রাণপাত করি। এটি শুধু আমাদের স্বপ্ন নয়, এটাই গুরুত্বপূর্ণ অবশ্য প্রয়োজন। আমরা প্রত্যেকে এতটাই একে অপরের উপর নির্ভরশীল যে একাকী কোনো জাতি, কোনো সম্প্রদায়, কোনো দেশের পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়।… আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আপনাদের কাছে একথাগুলি নিবেদন করলাম। যদি মনে করেন একজন সাধারণ যোগী যা বলছেন তা আপনারা পালন করতে সদিচ্ছুক, তবে আশা করব তা পালিত হবেই।…”
সেদিন তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে মানবপ্রেমের আকুলতাকে সম্মান দিয়ে প্রার্থনা করেছিলেন শান্তির বাতাবরণ মানুষে মানুষে, জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে, দেশে দেশে চিরকালের জন্য বইতে থাকুক। সেই মিলনেই মানুষের মুক্তি। মানুষে একা বাঁচে না যেমন তেমনই বিভেদ বিরোধও চায় না। কিন্তু রাজনীতির প্যাঁচপয়জারে নাস্তানাবুদ হয়ে হিংস্র হয়ে ওঠে। দাঙ্গা করে। যুদ্ধ করে। ঘৃণা করে। হত্যাও করে থাকে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ভাবনায় একেই সভ্যতার সংকট বলে।তিরিশ বছর আগে ওসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাগৃহে আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যূবার্ষিকীর তিথিতে নোবেল শান্তি পুরস্কার হাতে নিয়ে চতুর্দশ দলাই লামা বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে এমনই আবেদন রেখেছিলেন। আজ তাঁর তিরিশ বছর পর বিশ্ববাসীর কাছে, ভারতবাসীর কাছে এই বাণী যেন আরও জোরালো দাবি নিয়ে অনুরণিত হচ্ছে।

প্রচ্ছদ: The Telegraph, UK
Khub satyi r prasongik lekha Pritam
He has always been the true ambassador of peace
LikeLike
The name of the author is Peetam Sengupta.
LikeLike