প্রমিথিউসের এক অমোঘ পরিণতি, ফ্র‌্যান্কেনস্টাইন : শাল্মলী রায়

“No change, no pause, no hope! Yet I endure.
I ask the Earth, have not the mountains felt?
I ask yon Heaven, the all-beholding Sun,
Has it not seen? The Sea, in storm or calm,
Heaven’s ever-changing Shadow, spread below,
Have its deaf waves not heard my agony?
Ah me! alas, pain, pain ever, for ever!”

এমন যন্ত্রণা জুড়ে জুড়েই তৈরী হয়েছিল পি.বি. শেলির তিন অঙ্কের কাব্যনাট্য “Prometheus Unbound”। প্রমিথিউস- অসহনীয় যন্ত্রণার প্রতীক;যদিও অর্থগত দিক দিয়ে দেখতে গেলে প্রমিথিউস সেই যে সময়ের পূর্বে চিন্তা করতে সক্ষম। কিন্তু সময়, সে তো নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার দ্বারা! যার হাতে ক্ষমতা ,সময়কে সেই চায় হাতের মুঠোয় বন্দী রাখতে এবং কখনো বা তার গতিকে বিপরীত দিকে বয়ে নিয়ে যেতে এবং এর বিরোধিতার শাস্তি ভয়ানক; স্বর্গ মর্ত্য পাতাল ব্যাপী যার প্রভাব বিস্তৃত । দেবতার সৃষ্টি যদি দেবতার বিরুদ্ধতা করে তবে সে পায় প্রমিথিউসের পরিণতি। প্রমিথিউসের মৃত্যু নেই; কেবল আছে অশেষ যন্ত্রণা। ঈগলের নখের তীব্র আঘাত অনবরত অবিরত। কারণ সে ছাপিয়ে গিয়েছিল তার সৃষ্টিকর্তাকে। চুরি করে এনেছিল আগুন আর মেরুদণ্ড সৃষ্টি করে মানুষকে করে তুলতে চেয়েছিল দেবতার সমগোত্রীয়। মানুষের প্রতি তার আস্থা, ভালবাসাকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে সে প্রমাণ করেছিল সে মানবিক, চিন্তাশীল, ন্যায় অন্যায়ের বিচারবোধসম্পন্ন। কিন্তু সে তার সৃষ্টিকর্তার জীবন্ত দু:স্বপ্ন। তাই তার জন্য, শুধু তারই জন্য বোনা হয় দু:সহ যন্ত্রণার ইতিহাস।
গ্রিক নাট্যকার এস্কাইলসের ক্লাসিকে অমর হয়ে আছে যেই যন্ত্রণা তারই আধুনিক এবং উপন্যাস রূপ পাওয়া যায় মেরি উলস্টোনক্রাফট শেলির লেখনীতে, ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের সৃষ্ট দানবে। মানুষের সমাজে যে ব্রাত্য, মৃত্যুর থেকে জন্ম হবার পর যার আর মৃত্যু নেই অথচ যার জীবনও নেই। তাই তার রয়েছে প্রতিশোধের আগুন; তার অপাংক্তেয় জীবনের সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে। এস্কাইলসের “প্রমিথিউস বাউন্ড” থেকে শেলির ” প্রমিথিউস আনবাউন্ড ” হয়ে মেরি শেলির “ফ্রাঙ্কেনস্টাইন “- যুগ যুগ ধরে ফিরে এসেছে প্রমিথিউস আর সেই ফিরে আসাই বিষয় হয়ে উঠেছে মণীশ মিত্র নির্দেশিত,কসবা অর্ঘ্য-এর নাটক ” প্রমিথিউস বাউন্ড ওর আনবাউন্ড: ফ্রাঙ্কেনস্টাইন” -এ। প্রমিথিউস যেখানে এক চূড়ান্ত অসাম্যের প্রতীক। “liberty, fraternity, equality ” শব্দত্রয় এক পরিহাসের মত তার জীবনে। মুক্তির একমাত্র পথ তাই হয়ে দাঁড়ায় মৃত্যু; সৃষ্টিকর্তা এবং তার সৃষ্টি দুয়েরই মৃত্যু। যন্ত্রণার অমরত্বের মৃত্যু; দর্শককে যা ভাবায় যে এই প্রমিথিউসেরা কি আজও আছে অন্য কোনোভাবে অন্য কোনো রূপে?
কেবল প্লটই নয়, অভিনবত্ব রয়েছে এ নাটকের পরতে পরতে; আঙ্গিকে, অভিনয়ে, মঞ্চসজ্জায়, সঙ্গীতায়োজনে এবং সংলাপে। ধ্রুপদী গ্রিক ট্র্যাজেডিকে ভারতীয় আঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলেছে রাগ সঙ্গীতের অনবদ্য মূর্ছনা। শেলির তিনাঙ্কের নাট্যকাঠামোর প্রতি অঙ্কে ব্যবহৃত ভিন্ন ভিন্ন রাগ; প্রথমাঙ্কে ভূপালি এবং ভূপকলি, নাটকের ধারাকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে যা পৌছে দিয়েছে দ্বিতীয়াঙ্কে পুরিয়া ধানেশ্রী সহযোগে এবং তৃতীয়াঙ্কের প্রবল বিষণ্ণতায় বাজতে থাকে ভৈরবী, যা করুণ হলেও ভোরের সূর্যোদয়ের আশ্বাস নিয়ে আসে। এরই সঙ্গে ব্যবহৃত শাস্ত্রীয় নৃত্যের শৈল্পিক, সচেতন এবং যথাযথ ব্যবহার যা রাজু বেরা এবং তার সহ অভিনেতাদের অভিনয়ের মাধ্যমে নাটকের উত্তরণ ঘটিয়েছে অসামান্য নান্দনিকতায়। সংলাপ এই নাটকে কেবল কিছু শব্দ দিয়েই তৈরী হয়নি,তার সঙ্গে মিলেমিশে গেছে নৃত্যশৈলীর শারীরিক ভাষা।আলাদা করে প্রশংসার দাবী রাখে মঞ্চসজ্জা। পাহাড়ে শিকলবন্দী প্রমিথিউসের আবছায়া প্রতিকৃতি আলোর ব্যবহারে দর্শককে এক মুহুর্তের জন্যও ভুলে যেতে দেয় না প্রমিথিউসের পরিণতিকে। বিষণ্ণতার এমন উত্কৃষ্টতম নান্দনিক উপস্থাপনায় কোথায় যেন ফিউশনও হয়ে ওঠে ক্লাসিক। শৈল্পিক চেতনার ছোঁয়ায় গ্রিক ট্র্যাজেডি মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ভারতীয় আঙ্গিকে এবং কোথায় যেন যুগের সীমানা পেরিয়ে তা হয়ে ওঠে মহকাব্যিক গুণসম্পন্ন।

picture courtesy: Promethee Delivre by Jacques Villon