‘উলটে দেখুন পাল্টে গেছে’- কত ইয়ার্কিচ্ছলেই না মুখে মুখে ঘুরেছে দৈনিক সংবাদপত্রের এই ট্যাগলাইনটি। নোভেল করোনা, মশকরার মোড়ক খুলে, এই উল্টো ক’রে পাল্টে যাওয়ার ভয়াবহ অবয়বটিকে সটান দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাদের সামনে। আর এই পাল্টে যাওয়ার নানাবিধ ঘটনা প্রবাহের মধ্যে একটা হল অনলাইন ক্লাস।এই অনলাইন ক্লাসে ঢোকার আগে বুঝে নিই একজন ৭, ৮ বা ১০ বছরের বাচ্চার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যে, কেমন ছিল প্রাক-করোনা অবস্থাটা। সেখানেও অবশ্য স্থানভেদে বদলে যাবে দৃষ্টিভঙ্গি। যোধপুর পার্কের মেয়েটির সঙ্গে কিছুতেই একরকম হবে না যোগেশগঞ্জের ছাত্রীটির যাপন চিত্র। আমি শহর কলকাতা বা বৃহত্তর কলকাতার বেসরকারি স্কুলের কথা দিয়েই শুরু করি আগে। তারা হইহই করে স্কুলে যেত। পাশাপাশি, ভাগাভাগি করে টিফিন খেত। জলের বোতল নিয়ে ক্যাচ-ক্যাচ খেলত। বেঞ্চের পেছনে বসে লুকিয়ে সামনের বন্ধুর শার্টে পেনের কালি লাগিয়ে দিত(সবই অবশ্য সিসিটিভি ক্যামেরা বাঁচিয়ে )। এসব স্কুলের বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েরাই নাচ-গান, সাঁতার, বেহালা, রোলার স্কেটিং, টেনিস, গীটার -সপ্তাহের অন্তত একদিন বই থেকে মুখ তোলার অবকাশ পেত। বাবা মা’র চাপে এসব বাধ্যতামূলক এক্সট্রা কারিক্যুলামে খুশিতে নতুন কিছু শেখার আনন্দ সেভাবে না পেলেও সমবয়সীদের সঙ্গে সময় কাটানো সবসময়ই অতিরিক্ত আরাম দিত তাদের। প্রায় তিন মাস হতে চলল বাবা-মার মুখ দেখতে দেখতে সেই ছোটটিও ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। চাইছে বন্ধুর হাত ধরতে। আর হয়তো বুঝতে পারছে না, কিন্তু খিটখিটে হয়ে থাকছে হালকা আঁচ করে যে, যে কম্পিউটার বা মোবাইল-এর জন্য একসময় হাপিত্যেশ করত সেই ভার্চুয়াল জগতটাও কতটা একঘেঁয়ে! একঘেঁয়ে এটা ভেবে নেওয়া যে, বাড়ির স্টাডিটা আসলে ক্লাসরুম। আর সেই ক্লাসরুমে মাঝে মাঝে মা চ’লে আসতে পারেন, বাড়ির পোষ্যটি লেজ নাড়িয়ে ঢুকে যেতে পারে, কাজের মাসি ফ্যান অফ করে মোছামুছি শুরু করে দিতে পারেন। আবার ক্লাসে রেস্পন্সিভ না হলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে ভেবে শঙ্কিত গাঁট্টাও জুটতে পারে গার্জিয়ানের কাছে! কোন কর্পোরাল পানিশমেন্ট এই ক্লাসে বলবৎ হবে না। ঘরে, থুড়ি, এই ক্লাসরুমে কোন সিসিটিভি-ও নেই। মা, বা বাবা যদি হেলিকপ্টার হন তাহলে খুদেটি ভিডিও অফ করে একটু হাই তুলতে পারবে না বা জানলার দিকে তাকাতেও পারবে না। আসল ক্লাসে এসব তো হয়, নাকি? পরীক্ষার পর বেড়াতে যাওয়া হয়নি সেভাবে। কবে আবার বেরোতে পারবে তাও জানা নেই। ছোটদের তো জানা নেইই, এমনকি তারা যাদের সবজান্তা, বিদ্যের জাহাজ মনে করে সেই বড়দেরও জানা নেই এই গৃহবন্দী কালাতিপাত আর কতদিন!
এবার তাকাই সরকারি স্কুলের দিকে। না, এই স্কুলে সবার স্মার্টফোন নেই। থাকলেও, নিরবিচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক সংযোগের ব্যবস্থা নেই অনেকক্ষেত্রেই। একজন অভিভাবক তো বলেই ফেলেছেন, “বাচ্চার পেট ভরাতে পারছি না, মোবাইলে নেট ভরাবো?” অনুমান করা যায়, অসুবিধা নয়, প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াটি। কয়েকজন সরকারি স্কুল-শিক্ষিকাদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম হোয়াটসঅ্যাপে যে ক্লাস হচ্ছে সেটা স্ক্রিনশট, অডিও ক্লিপ বা রাইটিং ফর্ম্যাটে। ক্লাসে যতজন ছাত্র-ছাত্রী তার মোটামুটি ৫০% হোয়াটসঅ্যাপে রয়েছে ,তার মধ্যেও অনেকে নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে যোগদান করতে পারছে না। আবার অনেকের বাড়িতে একটি স্মার্টফোন। এখন আনলকের বাজারে সেই ফোনটি নিয়ে বাবা বেরিয়ে গেলে ক্লাসের ওখানেই ইতি। যে স্কুলশিক্ষিকাদের কথা বললাম সেই স্কুলগুলির কিছু খাস কলকাতায়, বাকি বৃহত্তর কলকাতায়। কলকাতা ও বৃহত্তর কলকাতার এমন একটি অসম চিত্রের পাশাপাশি খবর এল, পঞ্জাবের মানসা জেলার একটি ১৭ বছরের মেয়ের। মেয়েটির বাবা একটি ফার্মে কাজ করত। করোনা মহামারী আর লকডাউনজনিত কারণে পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল যাচ্ছিল না। বেশ কিছুদিন ধরে মেয়েটি তার বাবাকে স্মার্টফোন কিনে দিতে বলছিল, কিন্তু, বাবা কিনে দিতে পারেননি। তাই মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। একই ঘটনা কেরালার মালাপ্পুরামে। স্মার্ট ফোন খারাপ হয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। এমনকি টিভিটিও খারাপ হয়ে পড়েছিল বেশ কিছুদিন আগে থেকেই। কাজেই কেরালায় পয়লা জুন থেকে টিভি চ্যানেলে যে অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে তাতেও যোগ দিতে পারেনি সেই ছাত্রীটি, অবসাদে গায়ে আগুন দিয়েছে সে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া সন্তানের অনলাইন ক্লাস করা নিয়ে ডগমগ আমরা যদি নিজেদের ঘরের দিকে চোখ ফেরাই, দেখব, বাড়ির পরিচারিকার সন্তানটির স্কুল বন্ধ, পড়াশোনা বন্ধ, টিউশন বন্ধ। প্রাণপাত ক’রে কন্যাকে গ্র্যাজুয়েট করার স্বপ্ন দেখে এসেছে যে মা, যে মোটিভেশন নিয়ে সে ভোর পাঁচটায় লোকাল ট্রেনে উঠে শহরে এসেছে বাসন মাজতে আজ তার সর্বস্ব খোওয়া গেল। সামন্ততান্ত্রিক আবহে আমরা শুধু জেনে গেলাম- একটি ছেলে তিন মাস বেকার বসে থেকে প্রায় স্কুলছুট হয়ে গেল, কেউ কেউ স্রেফ মরে গেল, কেউ কেউ স্কুলের জামা প্যান্ট পড়ে ঢুলুঢুলু চোখে মায়ের গাঁট্টা খেয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল, কেউ কেউ দারুন কমফর্টবলি ‘সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট’-এর পরীক্ষায় বৈতরণী পার করল।কিন্তু, আরও যে কিছু জানতে হবে আমাদের! জানতে হবে ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ২৮ হাজার গ্রামে মোবাইল ফোন কভারেজ নেই আমাদের দেশে।
আমাদের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক মানুষ সরাসরি ইন্টারনেট সংযোগের সুবিধা পান। কাজেই শিক্ষাব্যবস্থায় ক্লাস ডিফারেন্স আরও অনেক বেশি প্রকট হয়ে পড়বে এই নিউ নর্মাল ব্যবস্থায়। সেদিন একটি আর্টিকেলে পড়ছিলাম অনলাইন শিক্ষার ফলে হোমোজিনাইজেশন অফ নলেজের ব্যাঘাত ঘটবে। শিক্ষক-ছাত্র আদান-প্রদানের বিষয়টা শ্রেণিকক্ষে যেমন হয় তেমনটা ডিজিট্যালি বা ভার্চুয়ালি সম্ভব নয়। এর ফলে একটা জিজ্ঞাসু মন নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে একজন ক্রিটিকাল সিটিজেন হবারও। করোনার জের কবে শেষ হবে কেউ জানে না। ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে এদেশের কোণে কোণে কবে পৌঁছাতে পারবে সে নিয়েও প্রশ্ন চিহ্ন। ১৯৭৮-এ পোলিও ভ্যাকসিনেশন শুরু হয়ে ২০১১-তে লাস্ট কেস পাওয়া গেছে এ দেশে, আমাদেরই রাজ্যে! তাহলে চিন্তা করুন করোনা-ফ্রি হতে কত যুগ লাগবে আমাদের? সেক্ষেত্রে খোলনলচে বদলে ক্লাসরুম শিক্ষাব্যবস্থাকে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে ছাত্র-ছাত্রী অভিভাবকদেরও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। তাছাড়া, কি হবে স্কুলের অশিক্ষক কর্মচারীদের? তাদের জন্যে কোন বিকল্প ব্যবস্থা?অনেক গার্জিয়ান বলছেন অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার কী বিকল্প? না, এই মুহূর্তে তো কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আরও এক বছর পরেও যদি এমনই করোনাতঙ্ক থাকে এবং তখনও যদি বিকল্প ব্যবস্থা বা এই অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থাই প্রত্যেকটি প্রান্তিক ছেলে-মেয়ের মধ্যে পৌঁছে না দেওয়া যায় তাহলে কি বুঝে নেব যে, বিকল্প না খোঁজাটা একটা কৌশল? প্রাথমিক শিক্ষাও সাধারণের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত? সময় বলবে সে কথা।
ইতিমধ্যে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’-এর মতো ‘স্টাডি ফ্রম হোম’-এ অভ্যস্ত হতে থাকি আমরা। অভ্যস্ত হতে থাকি পাঠ্যপুস্তক পিডিএফ-এ পড়ায়, অভ্যস্ত হতে থাকি হেল্পলাইন নম্বরে ফোন ক’রে বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দপ্তরের পোর্টালে গিয়ে হোমওয়ার্ক ডাউনলোড করতে। অভ্যস্ত হওয়ার সুযোগ যখন আমরা পাচ্ছি, তখন নেব না কেন? বটেই তো। “ইফ আ উইন্ডো অফ অপারচ্যুনিটি য়্যাপিয়ার্স, ডোন্ট পুল ডাউন দ্য শেড”। কিন্তু পশ্চাতে রেখেছি যারে, সে-ও মনে করতে পারে আইনস্টাইনের সেই বিখ্যাত উক্তি, “ইন দ্য মিডল অফ ডিফিকাল্টি লাইস অপারচ্যুনিটি”। তখন কিন্তু লড়াইটা সমানে-সমানে। আমাদের আদরের নাড়ুগোপালদের সে যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়ানোর হিম্মত থাকবে তো?
© Kothabriksha, All Rights Reserved.
গুরুত্বপূর্ণ লেখা। এ নিয়ে আলোচনা সত্যি কাম্য। রাতারাতি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে যেন সমাজের ক্ষতি না করি, তার জন্যই অনলাইন শিক্ষা নিয়ে এই বিশ্লেষণ জরুরি।
LikeLike
ধন্যবাদ মানসদা | দীর্ঘদিন বিজ্ঞানশিক্ষা নিয়ে তুমি গবেষণামূলক চর্চায় নিয়োজিত বলে তোমার মতামত সবসময়ই আমার কাছ গুরুত্বপূর্ণ থেকেছে |
LikeLike
খূব সঠিক কথা বলেছেন। এই ধরনের একটা।আলোচনার খুব প্রয়োজন ছিল ।
LikeLike
অজয়বাবু, ধন্যবাদ | সত্যিই কোভিডের চাপে শিক্ষাব্যবস্থা ভয়ানকরকমের ক্ষতিগ্রস্ত হ’ল |
LikeLike
অফবিট অনলাইন ব্যাপারে বলি।সত্যি এ নিয়ে আলোচনার দরকার এবং খুব শীঘ্রই।দিনে দিনে পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে জানিনা আর কত দিন এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের বাঁচতে হবে।শিক্ষা ব্যবস্থা এক্কেবারে অন্তরজলি যাত্রায় যেতে বসেছে।রাজনৈতিক নেতাদের কি সেদিকে নজর দেওয়ার ফুরসৎ আছে?তারা তো শুধু নিজেদের আখের গোছানোর তালেই আছে।
LikeLike