ধরা যাক আজ রোববার – সম্পাদকীয়


রবিবার .. সানডে … সপ্তাহের এই একটা দিনের জন্য সমস্ত মানুষের কত অপেক্ষা, কত জল্পনা, কল্পনা। সারা সপ্তাহের কর্মক্লান্ত দিনগুলি পার করা যেন এই একটা দিনের দিকে তাকিয়েই। সকালে ওঠার তাড়া নেই, নেই ঘড়ির কাঁটার চোখ-রাঙানি, বসের মুখ দর্শনের থেকে গিন্নির মুখ-ঝামটাও যেন আজ বড় মধুর। এই একটা দিনই যে নিজের খেয়াল খুশিদের স্পর্ধা দেখানোর দিন। ঔচিত্য ও স্বাস্থ্য-খাদ্যের ভাড়ে কুঁকড়ে থাকা রসনার লাগামহীন তৃপ্তি দাবির দিন।


আচ্ছা, মনে প্রশ্ন জাগে না কখনও যে রবিবার দিনটিকেই হঠাত সারা বিশ্বজুড়ে ছুটি হিসেবে মেনে নেওয়া কেন? কবে থেকেই বা রবিবারের এই মর্যাদাপ্রাপ্তি? সম্ভবত প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীর সময়কালে, রোমান ক্যালেন্ডারে সপ্তাহের সাতটি দিন চিহ্নিত হয় গ্রহ-নক্ষত্র বা তার সাথে জড়িত দেবতার নামে। এই ভাবেই সপ্তম দিনটি হয় Dies Solis (সূর্য এর দিন)। এটি এর পর জার্মান ভাষায় হয় সনট্যাগ (Sonntag) যা পুরনো ইংরেজি ভাষায় সুনেদাই (Sunnedai) এবং পরবর্তীকালে সানডে(Sunday) হিসেবে বলা হয়ে থাকে। ভারতবর্ষে, এর সাথে সহ-সামঞ্জস্যেই, এই দিন হয় রবিবার বা নক্ষত্র রাজ সূর্য দেবতার দিন। শোনা যায়, রোমান সম্রাট কন্সটানটাইন I, প্রথম রবিবার দিনটিকে প্রার্থনার দিন হিসেবে চিহ্নিত করেন ও সেই উদ্দেশ্যে সব কাজকর্মের বিরতি ঘোষণা করেন এই দিনে। সেই থেকে আজও ধর্ম ভীরু খ্রিস্টানদের চার্চে যাওয়ার দিন হল রবিবার, ছুটির দিনও বটে। তবে ইজরায়েল, বাংলাদেশের মত পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে কিন্তু সাপ্তাহিক ছুটির দিনটি রবিবার নয়। সেখানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার প্রয়োজনানুসারে সাপ্তাহিক ছুটির দিন হল শুক্রবারে। ভারতবর্ষে রবিবার ছুটি চালু হয় ব্রিটিশ শাসনকালে। একসময়, রবিবারের ছুটির অধিকার ছিল একমাত্র ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত কর্মীদেরই। ভারতীয় শ্রমিকদের কোনও ছুটির দিন ছিলনা। নারায়ণ মেঘাজী লোখান্ডে নামে একজন শ্রমিক নেতা প্রথম দাবী তোলেন মিলে কর্মরত শ্রমিকদের সাপ্তাহিক ছুটির যা অবিলম্বে খারিজ করে দেয় ব্রিটিশ সরকার। দমে যান না লোখান্ডে। লাগাতার ৭বছর সংগ্রামের পর অবশেষে ১০ই জুন ১৮৯০ সালে লোখান্ডের দাবী মেনে রবিবার সার্বিক ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত হয় ভারতবাসীর জন্য। 


অতএব, ধরা যাক আজ রোববার, কোনও কাজ নেই… ধরা যাক আজ রোববার, কোনও তাড়া নেই…রোববারকে নিয়ে বাঙালীর রোমান্টিসিজমের শুরু। রবিবার মানেই দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা। ঘুম ভেঙে গেলেও আবার একটু পাশ ফিরে শুয়ে পড়ার মধ্যে যে আরাম সেটার কোনো তুলনা হয়না। আমরা যখন ছোটো তখন রবিবারের সকালে বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁকে যেত একটি লোক মাথায় এক ডেচকি ভর্তি শংখ সন্দেশ, জিলিপি, মোয়া এবং আরও কত কি। ওর ডাক টা না শুনলে রবিবার গুলো অসম্পূর্ণ থেকে যেত। সেই সন্দেশ এবং জিলিপি দিয়ে শেষ হতো প্রাতঃরাশ। সাথে অবশ্যই থাকত লুচি, ছোলার ডাল বা সাদা আলুর তরকারি।


তারপর পাড়ার বন্ধুরা মিলে কেউ আঁকা কেউ বা গানের ক্লাস। সারা সপ্তাহের ফাঁকির পর ক্লাসের আগে নাচের বা গানের খাতা খুলে মেক আপ দেওয়ার চেষ্টা! ক্লাস সেড়ে বাড়ি ফেরার সময় নাকে ভেসে আসা মাংসের গন্ধর কথা মা বাবার মুখেও শুনেছি। ওদের ছোটো বেলাতেও রবিবার মানেই ছিল সবার বাড়িতে পাঁঠার মাংসের ঝোল। 


বাঙালী খাদ্যরসিক একথা তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু বাঙালীর আরেকটি প্রিয় অভ্যাস বোধহয় বাজার করা। মহামারির প্রকোপ বা তার সাথে জড়িত নিষেধাজ্ঞাও যাকে এতটুকু খর্ব করতে পারে না। আর রবিবার ছাড়া এরকম একটা বাঁধনহীন সময় আর কবে পাওয়া যাবে? তাই তো হাঁকে ডাকে, দর কষাকষিতে, ইলিশ, চিংড়ি, চিতলের পেটি, কচুর লতি আর মোচার ছরা, মাংসের দোকানে লাইন আর মুরগির দোকানের তর্কে সরগরম হয়ে ওঠে বাজার আর রবিবারের সকালগুলি।


খুব ছোটবেলার কথা, অনেক রকম ফেরিওয়ালার আগমন মনে পড়ে। শিশি বোতল ওয়ালা, বাসন ওয়ালা, শিল কাটানো, ছুরি কাঁচি ধার করানো – এদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা সুরের ডাক – এখন অবশ্য এই ডাকগুলি হারিয়ে গেছে কোথাও। আর রবিবারের আড্ডা? এছাড়া কোনও রবিবার সম্পূর্ণ হয় নাকি? চায়ের কাপে তুফান তুলে সারা বিশ্বের রাজা-উজিরকে নাচিয়ে, ইস্টবেঙ্গলকে আনায়াসে দুই গোল দিয়ে, মোহনবাগানের ডিফেন্ডারকে ট্যাকেল শিখিয়ে, অমিতাবচ্চনের নাচ আর গাভাস্করকে সেঞ্চুরি করিয়ে তবে না একটু মনের শান্তি হয়! আরেকটা প্রথা ছিল রবিবারে। ডিজিটাল মিডিয়ার অনুপস্থিতিতে তখনও আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যাওয়া বা হঠাত করে বাড়িতে তাঁদের আগমন ঘটা অস্বাভাবিক ছিলনা। হ্যাঁ খবর না দিয়ে এলেও কেউ অখুশী হত বলে মনে হয়নি কখনও।

 
এখন অবশ্য অনেক বদল ঘটেছে রবিবার যাপনে। আত্মীয়-স্বজন দূরস্থান এখন মানুষ নিজের পরিবার থেকেও সপ্তাহের কাজের ভারে বিচ্ছিন্ন। তাই রবিবার নিজেদের সাথে সময় কাটানো, নিজেদের খুঁজে বেড়ানোই এখন মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে। দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা, প্রাতরাশ আর দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের মাঝামাঝি ব্রাঞ্চ করা, শপিং মল বা লং ড্রাইভ, সবেতেই বাঙালী এখন মনেপ্রাণে কন্টিনেন্টাল। বাড়িতে মাংস রান্নার থেকে হোম ডেলিভারি আনিয়ে নেওয়া বা রেস্টুরেন্টে খেয়ে আসাতে সে এখন অনেক বেশী স্বচ্ছন্দ। আড্ডারও রকমফের হয়েছে, চাহিদার সাথে সাথে বদল হয়েছে আমাদের চরিত্রেরও।


না। কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল এ নিয়ে তর্ক নিষ্প্রয়োজন। যুগের সাথে, সময়ের সাথে বদল আসে অনেক কিছুর। তাকে খোলা মনে গ্রহণ করাটাই বেঁচে থাকার রীতি। কিন্তু কিছু জিনিস থাকে যা কখন যে রীতি থেকে আমাদের মজ্জায় ঢুকে গিয়ে সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায় তা নিজেরাও টের পাইনা। আমাদের রবিবার যাপনও সেইরকম একটা সংস্কৃতি, সামাজিক সত্যে পরিণত হয়েছে। তাই তো ইউ-টিউব দেখে শুক্ত রান্না করে কখনও তাক লাগিয়ে দেওয়া মনের মানুষটিকে, ইলিশের স্বাদ রেস্টুরেন্ট থেকে নিজের হেঁশেলেই খুঁজে পাওয়া, বাবা, মা বা ভুলে যাওয়া দাদু বা ঠাকুমার জন্য একটু সময় বের করা, দুপুরে ছোটবেলায় পড়া গল্পের বই বা সেই স্কুল ছুটি আর হজমিগুলির বন্ধুগুলিকে মিস করা মনটার ছটফটানি কমাতে একটা ভিডিয়ো কল – এর সবের মধ্যেই আছে তো বাঙালীর রবিবার, তার একান্ত নিজের রবিবার, স্বাদে-গন্ধে, ভালো লাগায়, নস্টালজিয়ায় পরিপূর্ণ হয়ে।

Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.