ভোকাট্টা – সম্পাদকীয়

“পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা “…গানটা তো আমাদের সকলেরই খুব প্রিয় তবে এই শব্দগুলোর সাথে কি আমাদের সবার পরিচয় আছে ? নাম কি শুধু মানুষ গাছ বা পশুপাখিরই থাকবে ? না, একেবারেই না । নাম আছে আকাশে ওড়া ঘুড়িরও। হ্যাঁ একদম ঠিক,  এগুলো সবই ঘুড়ির নাম ।

এখন জেনে নেওয়া যাক এই ঘুড়ির উৎপত্তি কোথায় হয়েছিল! যতদূর জানা যায় আনুমানিক ২৮০০বছর আগে চীন দেশেই প্রথম ঘুড়ির ধারণা তৈরি হয়। পরে তা এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পরবর্তীকালে ইউরোপেও ঘুড়ির প্রচলন ঘটে ছিল। আমাদের বাংলায় নানা ধরনের ঘুড়ি প্রচলিত আছে।

একটা সময় ছিল যখন বছরের এই সময়টায় আকাশ দেখতে পাওয়া মুশকিল হয়ে যেত। আকাশের মুখ ঢাকা পড়তো সারি সারি  রঙবেরঙের ঘুড়িতে। ঘুড়ি, বাঙালির একটা নস্টালজিয়া ,এক বিশেষ অনুভূতি। বিশ্বকর্মা পুজোর বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত ঘুড়ি ,লাটাই , মাঞ্জার তোড়জোড় । দোকানে দোকানে মানুষের ঢল নেমে পড়তো। ঘুড়ি কিনতে যাওয়াটাও যেন এক উৎসব হয়ে উঠতো। কতক্ষণে বাড়ি নিয়ে এসে ঘুড়িগুলো কে আলাদা করে আলাদা আলাদা করে ,কল বেঁধে ,লাটাই-এ সুঁতো ভরে মাঞ্জা দেওয়া আর তারপরই ওড়ানোর পালা। বেশ কিছুদিন ধরে আকাশে ঘুড়ির মেলা নজরে পড়তো সবারই ,আর বিশ্বকর্মা পুজোর দিন তো কথাই নেই !সপরিবারে ছাদে উঠে শামিয়ানা খাটিয়ে চলত আনন্দ  উৎসব। বেশ কিছুক্ষণ ঘুড়ি ওড়ানোর পর শামিয়ানার নিচের ছায়া টা খুব দরকার হতো আর তার সাথে সাথে চলতো জলখাবারের পালা। কলকাতার সব বড় বড় বাড়ির জন্য অনেক দূরে ঘুড়ি উড়তে দেখা যেত না ঠিকই, কিন্তু কলকাতার বাইরের মানে মফস্বলের দিকে খোলা আকাশে বহুদূর অবধি দেখা যেত উড়ন্ত  ঘুড়ির ঝাঁক। ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করেই এক ঝাঁক ঘুড়ির দেখা সহজেই পাওয়া যেত। ঘুড়ি ওড়ানো শুধুমাত্র একটা অনুভূতি নয় একটা নেশাও ছিলো বটে ! রাস্তায় যেতে যেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে ঘুড়ি যে দিকে যাচ্ছে সেদিকে যাওয়ার চল সেই কবে থেকে ..সেফটি রুলস সিকে তুলে তখন  ঘুড়ির পিছু নেওয়া যায় যতদূর পর্যন্ত সেটাই ছিল লক্ষ্য। ঘুড়ি কাটতে পারলে তো আর কথাই নেই, বিশাল চিৎকার করে “ভোকাট্টা” বলে দলবেঁধে হইহই করে ওঠা, সেই হইহই রব পাড়ার এ-বাড়ির ছাদ থেকে ও-বাড়ির ছাদে ছড়িয়ে পড়তে বিশেষ সময় লাগতো না। আবার এই ঘুড়ি নিয়ে কতই না রাগারাগি, অভিমান হতো এমনকি ঘুড়ি ধরা নিয়ে মারামারি ও চলত ভাইবোন বা বন্ধুদের  সাথে।

আজ ঘুড়ি নিয়ে লিখতে লিখতে, হঠাৎ মনে পড়ে গেল একটি হিন্দি সিনেমার কথা, যেখানে রাজস্থানী প্রাসাদে বাড়ির সবাই ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, আর তারই ফাঁকফোকরে সালমান খান আর ঐশ্বর্য্য রাই-এর মধ্যে খেলা করছে প্রেমের মেঘ-রৌদ্র। ‘হাম দিল দে চুকে সানাম’ সিনেমাটির সেই দৃশ্য গুলোর কথা অনেকেরই হয়তো মনে আছে। আবার প্রথম মাঞ্জা দেওয়ার দৃশ্য দেখেছিলাম ‘জাপানিজ্ ওয়াইফ’-এ। সেখানেও ছিল গ্রাম বাংলার ঘুড়ির লড়াইয়ের এক অভিনব নিদর্শন। কাঁচ বেটে সেই কাঁচের গুঁড়োর সাথে আঠা মিশিয়ে মাঞ্জা দেওয়ার ব্যাপারটা সেখানে দেখা গিয়েছিল। কুমারটুলির পথে, গঙ্গার তীর জুড়ে বা কলকাতার অলিতে গলিতে এখনো মাঝে মাঝে গেলে দেখা যায় মাঞ্জা দেওয়া কাকে বলে।  ফরিয়াপুকুর বা উত্তর কলকাতায় অনেক জায়গাতে এই বিশ্বকর্মা পুজোর আগে ঘুড়ির দোকান বসতো আলাদা করে। লাইন লেগে যেতো ঘুড়ি কেনার। তবে বিশ্বকর্মার হাতে ঘুড়ি দেওয়ার মানেটা আজও স্পষ্ট হয়নি। তবু ছোটবেলা থেকেই সবাই জেনে এসেছি বিশ্বকর্মা পুজো মানেই ঘুড়ি। যদিও স্বাধীনতা দিবসের দিনও অনেক জায়গায় ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন আছে। আবার অনেক মফস্বল শহরে পৌষ সংক্রান্তিতে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। আকাশ ছেয়ে যায় রঙিন ঘুড়ির ভিড়ে। শোনা যায় একসময় বাবুয়ানির কালে ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে চলত বিস্তর লড়াই, সেই ঘুড়ির লড়াই কলকাতার মানুষের কাছে ছিল এক দেখার মত জিনিস। আজ এই ঘুড়ি অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছে, কজনই বা আজকের দিনে ঘুড়ি ওড়াতে পারে বা কল বাঁধতে পারে, তা বোধহয় হাতে গুণে বলা যাবে। ঘুড়ি কেটে পড়লে ছুঁটে গিয়ে তা ধরতে যাওয়ার ধুম নেই, মাঞ্জা দেওয়ার বালাই নেই, আজ আর কাউকে লাটাই ধরার জন্য সঙ্গ দিতে হয় না।আজ সবকিছুই ডিজিটাল। তবুও যে ক’টি ঘুড়ি এখনও আকাশে দেখতে পাওয়া যায় সে বিশ্বকর্মা পুজো হোক বা স্বাধীনতা দিবসই  হোক আর পৌষ সংক্রান্তি হোক; নীল আকাশের বুকে সেই কটা ঘুড়ি’ই আজ সম্বল।

সেই ছবিগুলো এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। পাল্টে গেছে মানুষের অনুভূতি ,কমে গেছে সময় ।এখন হাই-রাইসের ভিড়ে  আকাশের দেখা পাওয়াই দায়, আর ঘুড়ি তো দূরের কথা। তাও ঘুড়ি যে একেবারে দেখা যায়না তা বললে ভুল হবে ।এখনও রঙবেরঙের ঘুড়ি উড়তে দেখা যায় আকাশে ঠিকই কিন্তু আকাশের মুখ আর ঢাকা পড়ে না সেই ঘুড়ি তে।আগে যেমন ঘরে ঘরে পারিবারিক উৎসবে পরিণত হতো এই ঘুড়ি ওড়ানোর সময়গুলো, সেসব এখন আর হয় না বললেই চলে ।তবে এখনও বাচ্চা ছেলে মেয়েরা বিশ্বকর্মা পুজোর দিন মাঞ্জা দিয়ে লাটাই হাতে ঘুড়ি ওড়াতে বেরোয় সোশ্যাল মিডিয়া টিভি আর ভিডিও গেমের মধ্যে কয়েক ঘণ্টার জন্য ।

Copyright © Kothabriksha 2020, All rights reserved

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.