“রেওয়াজ করে যাও, তোমার কাছে মানুষ আসবে” – বিদুষী সুরঞ্জনা বসুর সাক্ষাৎকার

“রেওয়াজ করে যাও, তোমাকে কারোর কাছে যেতে হবেনা, তোমার কাছে মানুষ আসবে”…

শত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় বের করে কথাবৃক্ষের সহ-সম্পাদিকা , শ্রীতমার সাথে ভাগ করে নিলেন বেশ কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের সবার খুব শ্রদ্ধার এবং ভালোবাসার একজন মানুষ এবং স্বনামধন্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী বিদুষী সুরঞ্জনা বসু।

প্রশ্ন: তুমি এখন একজন প্রথিতযশা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী। এখন অনেক মানুষ তোমার গান মনোযোগ সহকারে শোনে, উপভোগ করে, আর তা থেকে শেখার চেষ্টা করে। ছোটবেলায় কখনো ভেবেছিলে এতো মানুষের কাছে পৌঁছবে গানের মাধ্যমে?

সুরঞ্জনা বসু: না সেরকম তো কখনোই ভাবিনি। কারণ ছ’ বছর বয়সে অতো কিছু তো বোঝা যায়না। ধীরে ধীরে সময়ের সাথে এই উপলব্ধিগুলো হয়েছে। সেই ক্লাস টু থেকে আমার সঙ্গীতশিক্ষার যাত্রা শুরু। হরিপ্রসাদ দাশের কাছে গান শিখতে শুরু করি। গান গাওয়ার শুরুটা খুব মেকানিক্যাল ছিল বললেই চলে – মানে এটা সা, এটা রে, এটা গা, এইভাবে করতাম। সঙ্গীতের বিস্তৃতি ধরার মত বোধ তো তখন তৈরি হয়না, সেটা হয়েছে অনেক পরে…

প্রশ্ন: তাহলে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত যে এক মহাসমুদ্র সেই বোধের শুরু কবে থেকে?

সুরঞ্জনা বসু : আমার এক মামা ছিলেন , উনি বলেছিলেন পন্ডিত প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আমাকে গান শেখাতে নিয়ে যাবেন। মাস্টারমশাই হরিপ্রসাদ দাশের কাছে বেশ কিছু বছর শেখার পর আমি মায়ের হাত ধরে চলে গেলাম গুরুজীর (পন্ডিত প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়) বাড়ি। আমার এখনো মনে পড়ে, সেই প্রথম দিনের কথা..
আমি সবে তখন সোম চিনতে শিখেছি। তখন তো কিছুই বুঝতাম না, গুরুজী একেকদিন একেকটি রাগ গাইতেন আমি এক কোণায় বসে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনে যেতাম। সে সময় সব স্বনামধন্য শিল্পীদের আসতে দেখেছি গুরুজীর বাড়ি ।
গুরুজীকে চিনতে, বুঝতে এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মধ্যে ডুবে যেতে আমার বেশ কিছু বছর সময় লেগেছে। তখনই বুঝেছিলাম, এ আর কিছুই নয়, কেবল সাধনা। ধরে থাকতে পারাটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। যেটা এখনো আমি আমার ছাত্রীদের বলে থাকি। যেমন সেই ছোট থেকে এখনো সঙ্গীতকে ঘিরেই আমার জগৎ।

প্রশ্ন: তুমি তোমার ছোটবেলা থেকে যাত্রাপথটা একটু যদি বলো কথাবৃক্ষের পাঠকদের জন্য।

সুরঞ্জনা বসু : শুরুটা তো যেমন বললাম, আমার মাস্টারমশাই হরিপ্রসাদ দাশের কাছে আট বছর ধরে শেখার পর গুরুজী পন্ডিত প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সতেরো বছর তালিম পাই, তারপর বিদুষী মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে শিখি। ষোলো বছর বয়সে মাধ্যমিক পাশ করে রেডিওতে অডিশন দিয়ে গান গাওয়া শুরু। আকাশবাণী আমার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং আজও করছে।
একবার রেডিওর পরীক্ষায় ভালো ফল করে উত্তেজনা ধরে রাখতে পারিনি। খবরটা পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম গুরুজীকে (পন্ডিত প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়) জানাতে। যে মানুষটা চোখে চোখ রেখে কথা বলেননি কোনোদিন, সেদিন মাথায় হাত রেখে বললেন, “তুমি রেওয়াজ করে যাও, তোমাকে কারোর কাছে যেতে হবেনা, মানুষ তোমার কাছে আসবে।”

আমার সৌভাগ্য হয়েছে অনেক গুণী মানুষের সংস্পর্শে আসার, এবং তাঁদের থেকে তালিম নেওয়ার। যেমন, পূরবী দত্ত, সুকুমার মিত্র, অমলেন্দু বিকাশ করচৌধুরী, অনসূয়া মুখোপাধ্যায়, মন্দিরা লাহিড়ী। আমি আপ্পাজির (পদ্মবিভূষণ গিরিজা দেবী) কাছে দীর্ঘ চব্বিশ বছর তালিম নিয়েছি এবং বর্তমানে আমি বিদুষী মঞ্জু সুন্দারামের কাছে শিখছি। এছাড়া আমার পরম বন্ধু রাজ্যশ্রী ঘোষের সাথে বসি, আমরা একসাথে সঙ্গীতচর্চা করি, গানও ভাগ করে নিই।

প্রশ্ন: সত্যিই এরকম গুরু ও বন্ধু পাওয়াও তো আমাদের কাছে সৌভাগ্যের। গুরু শিষ্যের যে সম্পর্ক তুমি দেখেছো, সেরকম সম্পর্ক কি আছে এখনো?

সুরঞ্জনা বসু : এই গুরু-শিষ্য সম্পর্ক, বা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, এটা ভ্যারি করে। আমি বহু স্টুডেন্টকে দেখেছি, কোনো একটা ইনস্টিটিউশনের কমোডিটি হয়ে যেতে। আবার খুব সুন্দর স্বাস্থ্যকর সম্পর্কও দেখেছি গুরু-শিষ্যের মধ্যে। আমার গুরুজী পণ্ডিত প্রসূন বন্দোপাধ্যায়ের মত বড় মাপের মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। ওনার গান শুনতে শুনতে কখন যে সেসব গভীরে ঢুকে গিয়ে শেখা হয়ে গেছে তা অনেক সময় নিজেই বুঝিনি।

আমি আমার শেখানোর বিষয়ে যেটা বলতে পারি, আমি একটা স্ট্রাকচার তৈরী করেছি, যে স্ট্রাকচার ধরে বা মেনে আমি গান শেখাই । যেমন, প্রথমে পাল্টা রেওয়াজ, তারপর দ্রুত বন্দিশ, সরগম, তান, তেহাই, তারানা, এবং সর্বোপরি তালের সঙ্গে কিভাবে যাবো, প্রতিটা বন্দিশের ভাবার্থ, প্রতিটা শব্দের মানে, এই সবটা মিলিয়েই আমার শেখানোর পদ্ধতি।

আমি ১৯৮৫ থেকে গান শেখাচ্ছি, এবং শেখাতে গিয়ে নিজেকে অনেক গবেষণা করতে হয়েছে, যে কিভাবে শেখালে ভালো হবে, কোনটা শেখালে ছাত্রীরা বুঝবে বা নিতে পারবে। এগুলো মাথায় রেখে আমি একটা স্ট্রাকচার তৈরী করেছি। এখন যখন খবর পাই, কেউ রেডিওতে এ-গ্রেড, কেউ বি অথবা কেউ বি-হাই পাচ্ছে, তখন খুব ভালো লাগে, মনে হয় যে, এদের তো আমিই গড়েছি।

তবে অভিভাবকদের মধ্যে একধরণের কম্পিটিটিভ মনোভাব লক্ষ্য করি। এরকম ধারণা থাকে যে এক-দুবছরের মধ্যেই তাঁদের সন্তানেরা সঙ্গীতে পারদর্শী হয়ে উঠবে, এবং “রিয়েলিটি শো”-তে যাওয়ার যোগ্য হয়ে উঠবে। আমি আমার ছাত্র-ছাত্রী এবং তাঁদের মা-বাবাদের প্রথমেই জানিয়ে দিই যে, সঙ্গীতে সমর্পন করতে হবে, আপনাদেরও সম্মান ও বিশ্বাস রাখতে হবে। আমাকে ওকে চিনতে হবে, এবং ওকেও আমাকে।

প্রশ্ন: তুমি তো শুধু সফল গায়কগায়িকাদের গুরুই নও, তুমি স্টেজেও পারফর্ম করো। পারফর্মিং আর্ট আর শেখানোর মধ্যে তো একটা পার্থক্য আছে, যদি শুধু পারফর্ম করতে তাহলে কি এই এক্সপিরিয়েন্সগুলো হতো?

সুরঞ্জনা বসু : একেবারেই না, শুধুমাত্র পারফর্ম করলে আমার এতো অভিজ্ঞতার ভান্ডার হয়তো তৈরীই হতো না। আমার কাছে ক্লাস এইট নাইনের মেয়েরাও শেখে আবার পঁচাত্তর বছরের মহিলাও শিখতে আসেন । তাঁদের শেখানো, তাঁদের সঙ্গে বন্ধুত্ত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখা – এগুলোর মধ্যে আমি এক অদ্ভুত আনন্দ এবং শান্তি খুঁজে পাই। আমি মনে করি সবাইকে যে বিরাট কিছু হতে হবে, তা একেবারেই নয়। যে যেভাবে আমার সান্নিধ্যে থাকতে চায়, আমি তাঁকে সেভাবেই গ্রহণ করি। এটুকু যদি করতে পারি, আমার মনে হয় সেটাই অনেক। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেওয়া এবং পারফর্ম করা, ছেলে মেয়েদের শেখানো, এই সবটাই একটা জার্নি। সঙ্গীতে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পন না করলে, সেই জার্নির আনন্দটা উপলব্ধি করা যায়না। যেদিন রেওয়াজটা ভালো হয়, সেদিনের মতো ভালোলাগা বা প্রশান্তি অর্থ-যশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তিতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

প্রশ্ন: তুমি কাদের গান শুনতে ভালোবাসো, বা কাদের গান শুনে তুমি নিজে শেখো?

সুরঞ্জনা বসু : তিন চারজন মানুষ আছেন, যাঁদের গান শুনে মোটামুটি সবাই এগোয়। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী, আমীর খাঁ সাহেব, আর অজয়দার (পন্ডিত অজয় চক্রবর্তী) গান তো খুবই সায়েন্টিফিক। অজয়দা একটা কথা খুব বলতেন, “অর্জন আর বর্জনটা শিখতে হবে, কতটুকু অর্জন করবো, আর কতটুকু বর্জন করবো। তা নাহলে স্বকীয়তা আসেনা।” আমি মনে করি সবার গান শুনতে হবে। আমি এই ঘরানা বলে, অন্য ঘরানার গান শুনবো না – এরকম করলে মুশকিল। সাথে এটাও বলবো, না শিখে অনুকরণ করে কোন লাভ নেই, শেখাটা যেন সবসময় জারি থাকে।

প্রশ্ন: আচ্ছা অনেক শিল্পীদের কথা তো আমরা জানতেও পারিনা, বা তারা প্রাপ্য সম্মান পাননা, বা প্রচারের অন্তরালে থেকে যান। তোমার এই ব্যাপারে কি মত?

সুরঞ্জনা বসু : আমি ভীষণ কপাল মানি, জানিস তো। প্রচুর লড়াই করেও হয়না, আবার কারো অনায়াসেই হয়। মানে যেমন পরীক্ষায় বেশ কিছু চ্যাপ্টার বাদ দিয়েও সবকিছু কমন পেয়ে যাওয়া। কানেকশন থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের যদি কেউ থাকেন, সেটা কি প্রিভিলেজ নয় ? অবশ্যই প্রিভিলেজ।

বাবা-মা স্টেজে নিয়ে বসে যাচ্ছেন, তার আর চিন্তা কোথায়, সেখানেই অর্ধেক পরিচয় হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কেউ ছিলই না, বা নেই ও – সেটাই আমাদের গর্ব। গুরুজী (পন্ডিত প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়) বা মীরা দি (বিদুষী মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়) বা অন্যান্য বহু স্বনামধন্য শিল্পীরা তাঁদের যোগ্য সম্মান পাননি। মারা যাবার পর গুরুজী পন্ডিত আখ্যা পেয়েছেন।

প্রশ্ন: শিল্পীরা তো এমনিতেই সমাজের একটা ভালনারেবল জায়গায় থাকেন, যেটা তোমার কথাতেও একটু উঠে এলো, তবে কোভিড তাঁদের আরো সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে। তোমার নিজের ক্লাস, অনুষ্ঠানের মধ্যে কি পার্থক্য দেখতে পাচ্ছ?

সুরঞ্জনা বসু : পারফর্মিং আর্টস তো খুবই affected. ঘরে বসে কি গান গাইতে ভালো লাগে? মিউজিশিয়ানদের ক্রাইসিসটা খুবই চোখে পড়ার মতন, গোটা বছর জুড়েই। মাস গেলে যে টাকাটা পাওয়া যায়, সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে এক্ষত্রে আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা খুব ইতিবাচক। কারণ এরকম বহু মানুষ আছে, যারা অনেক দূরে থাকা সত্ত্বেও আমার কাছে শিখতে চাইতেন কিন্তু পারতেন না। তাঁরা এখন খুব সহজেই আমার কাছে গান শিখতে পারছেন, এবং আমারও সেটা খুব ভালো লাগছে। এবং এই লকডাউন সিচুয়েশনে বাইরে বেরোনো যেহেতু কমে গেছে, আমার গানের চর্চা খুব বেড়ে গেছে,প্রচুর গান শোনা হচ্ছে। গুরুদের পুরোনো রেকর্ডিং হোক, বা বিভিন্ন শিল্পীদের গান ,আর এই সময় দাঁড়িয়ে পসিটিভ থিংকিং টা খুব প্রয়োজন ভালো থাকার জন্য।

প্রশ্ন: কোভিড কি তাহলে অনেকটাই প্রযুক্তিকে সবার কাছের করে দিলো?

সুরঞ্জনা বসু : হ্যাঁ, সে তো অবশ্যই। কারণ ছাত্রীরা কেউ ম্যাড্রাস, কেউ পুনে। জুম, গুগল মিট এসবের মাধ্যমে ক্লাস হচ্ছে । আমাকে এসব অপারেট করতে হচ্ছে। ভিডিও কলের মাধ্যমে গান শুনিয়ে গান শেখাতে হচ্ছে।

প্রশ্ন: আমরা ইন্টারভিউয়ের একদম শেষে চলে এসেছি, কথাবৃক্ষ ওয়েব ম্যাগাজিনের পাঠকদের কি তুমি কিছু বলতে চাও?

সুরঞ্জনা বসু : চারিদিকে একটা টালমাটাল অবস্থা, সে রাজনীতি বল, বা অন্য কিছু। শুধু মারামারি হানাহানি, এখন তো খবর শুনতেও ভয় করে। যেই কলকাতা কালচারাল ক্যাপিটাল ছিল, সেই কলকাতা এখন কোথায় হারিয়ে গেছে জানিনা। এই নেগেটিভ রিয়েলিটিতে দাঁড়িয়েও মানুষের দরকার একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ ও মনোভাবের, এবং সেটা যদি কথাবৃক্ষ দিতে পারে, তাহলে তো খুবই ভালো হয়।

বিদুষী সুরঞ্জনা বসু পাতিয়ালা ও বেনারস ঘরানার একজন অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য খেয়াল ও ঠুংরী-ধারার শিল্পী।এছাড়াও তিনি একজন অল্ ইন্ডিয়া রেডিও-এর প্রথম সারির শিল্পী হিসাবেও জনপ্রিয়। তিনি ‘কলাবিদ পুরস্কার’, ‘যদুভট্ট পুরস্কার’ ও ‘ সর্বোত্তম কলাকার পুরস্কারে’ ভূষিত হয়েছেন।

Copyright © Kothabriksha 2021, All Rights Reserved.

One Comment Add yours

  1. Prabir Kumar Bhadra says:

    সুরঞ্জন বসু কে অনেক ধন্যবাদ, কথিবৃক্ষের সহ সম্পাদিকা সৃতমা বাসু কেউ অনেক ধন্যবাদ, এত সুন্দর ইন্টারভিউ নেবার জন্য, আমরা অনেক কিছুই জানতে পারলাম, খুব ভালো লাগলো।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.