“কবির ব্রাত্য চিরসাথীরা” ~ পীতম সেনগুপ্ত


সেদিনটির কথা। জোড়াসাঁকোর আঙিনাতে তখন জনসমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ঘরও লোকে লোকারণ্য। দূরে এককোণে নীরবে দাঁড়িয়ে তিনিও চোখের জল ফেলছেন, অথচ তাঁর দিকে কারো নজর পড়েনি। ‘অসুখের ক’দিন দিনে-রাতে ছায়ার মতো সে তাঁর বাবামশাইর ঘরের আশেপাশে ঘুরেছে, যখন যা দরকার করে দিয়ে গেছে। আজ সব মান্য লোকেদের মাঝে তার কোনো অধিকার নেই যেন খাটের কাছে এগিয়ে আসবার’ সত্যিই তো নির্মলকুমারী মহলানবিশ যদি তাঁকে ডেকে না বলতেন,‘বনমালী, তুমি গুরুদেবের কাছে এগিয়ে এসে ওঁকে ভালো করে চেয়ে দেখো।’ সে বেচারা তখন কাঁচুমাচু মুখটি করে ভিড় ঠেলে খাটের কাছে এসে দাঁড়ায়। সত্যিই তো কতদিন ধরে নাগাড়ে কত সেবাই না সে করেছে। ‘ওর মনিব তো সাধারণ মনিব ছিলেন না, কাজেই প্রভু-ভৃত্যের সম্বন্ধটা স্নেহ-ভক্তির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছিল।’ নির্মলকুমারী নিজেই বলেছেন কত হাসিঠাট্টায় বনমালীর প্রতি কবির স্নেহের প্রকাশ তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। অথচ আজ সে বড়ো ব্রাত্য, আজ তাঁর কাজ বড় বেশি নিরর্থক। অথচ কবি তাঁর সারাজীবনে বোধহয় কোনো একটি দিনও এমন কোনো না কোনো পরিচারক বা সেবক ছাড়া থেকেছেন জানা যায়নি।

‘জীবনস্মৃতি’র পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় তিনি লিখছেন,“ভারতবর্ষের ইতিহাসে দাসরাজাদের রাজত্বকাল সুখের কাল ছিল না। আমার জীবনের ইতিহাসেও ভৃত্যদের শাসনকালটা যখন আলোচনা করিয়া দেখি তখন তাহার মধ্যে মহিমা বা আনন্দ কিছুই দেখিতে পাই না।…ভৃত্যদের উপরে আমাদের সম্পূর্ণ ভার পড়িয়াছিল। সম্পূর্ণ ভার জিনিসটা বড়ো অসহ্য।…”      এ বর্ণনা জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির। বলা বাহুল্য চাকরদের অনুশাসনেই তাঁদের সকল ভাইবোনদের ছেলেবেলা কেটেছিল। ছেলেবেলার সেই ভৃত্য-পরিবৃত্ত জীবনের অভ্যাস তাঁর বড় বেলাতেও রয়ে গিয়েছিল। ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় শুচিবায়ুগ্রস্ত ঈশ্বর বা ব্রজেশ্বর ভৃত্যের সেই গম্ভীর আচরণে বালক রবীন্দ্রনাথ হতাশ হতেন ঠিকই, কারণ খাবার দেবার ভার ছিল তাঁদের উপর। ব্রজেশ্বর কাঠের বারকোশে রাখা অনেক লুচির মধ্যে থেকে মাত্র একটা বা দুটো লুচি ছেলেদের পাতে উপর থেকে ফেলে দিতেন। ছেলেদের নামে বরাদ্দ দুধ ছেলেরা না চাইলে দিতেন না। এমনকী নিজেই খেয়ে নিতেন বলে রবীন্দ্রনাথ অনুযোগ করেছেন। তবে হ্যাঁ কবির মধ্যে ছন্দের প্রথম দোলা এই ব্রজেশ্বরই কিন্তু দিতে পেরেছিলেন। সন্ধ্যাবেলায় রেড়ির তেলে ভাঙা সেজের আলো জ্বালিয়ে ব্রজেশ্বর ছেলেদের চারদিকে বসিয়ে রামায়ণ মহাভারত পড়ে শোনাতেন। “আমরা স্থির হইয়া বসিয়া হাঁ করিয়া শুনিতাম।” ‘কৃত্তিবাসের সরল পয়ারের মৃদু কলধ্বনি’ কবির শৈশবকালকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল।

ছেলেবেলার আরেক ভৃত্য হলেন শ্যাম। খাঁটি পাড়াগাঁয় ভাষায় কথা বলা শ্যাম ছিলেন যশোরের ছেলে। মাথার চুলে খুব তেল মাখতেন। মজবুত চেহারার শ্যামের আসল নাম ছিল শ্যামলাল। তাঁর দরদী মন সত্বেও শিশু রবীন্দ্রনাথকে এক জায়গায় বসিয়ে রেখে তিনি গন্ডি কেটে দিতেন চারপাশে। রামায়ণে লক্ষণের টানা গন্ডির কথা মনে পড়ে যেত তখন শিশু রবির। ফলে গন্ডির বাইরে বেরিয়ে সীতার মতো বিপদে পড়তে নিমরাজি ছিলেন। মাঝে মধ্যে তাঁর হাতে মারও খেতে হত। শ্যামও ভালো গল্প করতেন। রঘু ডাকাতের গল্প, বিশু ডাকাতের গল্প শোনাতেন। জোড়াসাঁকোতে পিয়ারী, শঙ্করী দুই দাসীও ছিল। ছিল মানিক দাস এবং নদের চাঁদ নামের দুটি ভৃত্যও।জোড়াসাঁকোর ডাঙা পেরিয়ে কবি যখন শিলাইদহে, তখন বিদ্যেভূষণ নামে এক গৃহভৃত্যের কথা জানা যায়। চিঠিতে মৃণালিনীদেবীকে লিখেওছিলেন এমনটি, “বিদ্যেভূষণ আজকাল তোমার কাজকর্ম কী রকম করচে? ইদানীং তাকে ধমকে দেওয়ার পর কি তা স্বভাবের কিছু পরিবর্তন হয়েছে— বেচারার সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে অনেকদিন পর সম্মিলন হয়েছে, সেটা মনে রেখো…!” বোঝাই যাচ্ছে সেবকদের প্রতি তাঁর সুনজর ছিল। সাজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের খানসামা ছিলেন মোমিন মিঞা। একবার তাঁর আট বছরের মেয়েটি মারা যাওয়াতে আসতে দেরি করেছিল। কবি পরদিন সকালে এখবর জানতে পারেন। পরে ‘কর্ম’ একটি কবিতাটি লেখার সময় এই ঘটনার ছায়া পড়ে যেন। পরে ‘চৈতালী’ কাব্যগ্রন্থে তা স্থান পায়। কবিতায় লিখলেন,  

“ভৃত্যের না পাই দেখা প্রাতে।  দুয়ার রয়েছে খোলা       স্নানজল নাই তোলা,              মূর্খাধম আসে নাই রাতে।…. বাজিয়া যেতেছে ঘড়ি     বসে আছি রাগ করি—              দেখা পেলে করিব শাসন  বেলা হলে অবশেষে        প্রণাম করিল এসে            দাঁড়াইল করি করজোড়, আমি তারে রোষভরে       কহিলাম, ‘দূর হ রে,                   দেখিতে চাহি নে মুখ তোর।’ শুনিয়া মূঢ়ের মতো          ক্ষণকাল বাক্যহত              মুখে মোর রহিল সে চেয়ে— কহিল গদগদস্বরে, ‘কালি রাত্রি দ্বিপ্রহরে              মারা গেছে মোর ছোটো মেয়ে।’ এত কহি ত্বরা করি             গামোছাটি কাঁধে ধরি              নিত্য কাজে গেল সে একাকী। প্রতিদিবসের মতো              ঘষা মাজা মোছা কত              কোনো কর্ম রহিল না বাকি।”

সাজাদপুর, শিলাইদহ, পতিসরসহ জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অনেক সেবকই ছিলেন। তাঁদের মধ্যে বিপিন, ঝগড়ু, প্রসন্ন,উমাচরণ ও সাধুচরণরা কবি এবং কবির পরিবারের সব দেখা শোনা করতেন। এদের মধ্যে উমাচরণের প্রতি তাঁর দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু উমাচরণের আকস্মিক মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ এতটাই শোকে কাতর হয়েছিলেন যে পুত্র রথীন্দ্রনাথের কাছে তা প্রকাশও করেছিলেন। “উমাচরণ বাঁচবে না আমি জানতুম, তবু তার মৃত্যুর খবর পেয়ে আমার মন খারাপ হয়ে গেল।…ওর জীবন আমার জীবনের সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। আমার সেবা ওর পক্ষে অত্যন্ত সহজ হয়ে এসেছিল।…এবার দেশে ফিরে গেলে উমাচরণের অভাবে আমার জীবনযাত্রা কত দুরূহ হবে তা বেশ কল্পনা করতে পারছি।”

[ একবার উমাচরণের অসুস্থতার সময়ে ডাঃ দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রের চিকিৎসায় সেরে উঠলে কবি ডাঃ কে চিঠি দিয়ে ধন্যবাদ জানান ]

উমাচরণের মৃত্যুর পর সাধুচরণ আসে। সে ছিল গম্ভীর প্রকৃতির। ক্ষিতিমোহন সেনকে তাঁর কথা বলতে গিয়ে কবি বলেছিলেন, ‘আরে বলেন কেন মশায়, ও কি আমার ভৃত্য! যা গম্ভীর মনে হয় আমার গার্জেন। কথা তো শুনতেই পাই না, তবে যখন শুনি, গর্জন শুনি।’ আসলে সাধুচরণ কাজে পটু ছিলেন। কথাও কম বলতেন। ঠাকুরবাড়ির আরেক বিশ্বস্ত সেবক হলেন ঝগড়ু। কবি যখন জোড়াসাঁকোর বাড়িতে এসে তেতলার ঘরে উঠতেন, তখন সে ঘরের সব দায়িত্ব সামলানোর ভার ছিল ঝগড়ুর উপর। ঝগড়ু নিজে হাতে সব সামলাতেন। ঝাঁড়পোছ করে পরিস্কার করে রাখতেন ঘরদোর। কবির ছোট ছেলে শমীন্দ্রনাথকেও তিনি কাছে নিয়ে সেবা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ ইয়োরোপ পাড়ি দেবার সময় নাতনির জন্য ঝগড়ুকে নিয়ে একটি ছোট্ট মজার ছড়া লিখেছিলেন,“এক যে ছিল বাঘ তার গায়ে কালো দাগ,তাই বেজায় হল রাগঝগড়ুকে তাই বল্লে হেঁকে—যা এখুনি প্রাগ।”এই ঝগড়ু খুবই দাপুটে স্বভাবের ছিলেন। রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমা দেবীরাও তাঁর কথা মান্য করতেন।রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ কুড়ি বছরের নিত্যসঙ্গী ছিলেন বনমালী পারুই এবং মহাদেব। কবি বনমালীকে নীলমণি বলে মজা ডাকতেন। কালো কুচকুচে বনমালীর ধারণা ছিল মুম্বাই গেলেগায়ের রঙ ফর্সা হয়। কবি বনমালীকে ঠাট্টা করে বলতেন, “চল বোম্বাইতে গিয়ে থাকি এবার থেকে তোকে আমাতে।” বনমালী কবির রসিকতা ঠিক ঠিক বুঝতে পারতেন বলে কবি নিজেও খুশি হতেন। পুত্রবধুকে লিখেওছিলেন সেকথা, “ওর একটা মস্ত গুণ এই যে, ও ঠাট্টা করলে বুঝতে পারে, ঠিক সময়ে হাসতে জানে। ‘বশীকরণ’ নাটকে বনমালীকে দিয়ে কবি অভিনয়ও করিয়েছিলেন। বলেছেন, “বাঁদরটা আমার কাছে থেকে নাটক করতেও শিখে গেল।” 

[ কবির শেষ বয়সের বিশ্বস্ত সেবক বনমালী পারুই ]

                       কবির এই নীলমণি বাঁদরটাই বাইশে শ্রাবণের লেলিহান শিখা নিভে যাবার পর ওড়িশায় ফিরে যান। যাবার কালে রথীন্দ্রনাথ ও মীরা দেবীর কাছ থেকে রবীন্দ্রনাথের বহু বইপত্র, পান্ডুলিপি চেয়ে নিয়ে যান। সেখানে নিজের বাড়িতেই একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথের একটি বড়ো ছবি টাঙিয়ে এই নিরক্ষর মানুষটি প্রতি রাতে বাতি জ্বালিয়ে অপেক্ষা করতেন, যদি গাঁয়ের কেউ এসে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয় বাবামশায়ের বই পড়ে…..