করোনা আর লকডাউন পরিস্থিতিতে কেন জানি না বারবার মনে পড়ছিল ৫০ সনের মন্বন্তরের কথা। চোখে ভাসছিল ‘আকালের সন্ধানে’ বা ‘অশনিসংকেত’-এর দৃশ্যগুলো। প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ফ্যান’ কবিতাটা বা তুলসী লাহিড়ী’র ‘ছেঁড়া তার’-এর চরম পরিণতির ঘটনাটাও মনে পড়ছিল বারবার। তারপর যখন খবরের কাগজের পাতায় দেখলাম দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাইওয়ে আর রেলপথ ধরে এগিয়ে আসছে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকেরা, তখন তাদের পা’য়ের আওয়াজে যেন শুনতে পাচ্ছিলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘স্বাগত’ কবিতাটি। আবার রেলপথে শুয়ে থাকা শ্রমিকরা যখন মালগাড়ির চাকার তলায় কেটে ফালা ফালা হয়ে গেল, তখন মনে আসছিল কর্তার সিং দুগ্গলের ‘অলৌকিক’ গল্পের সেই পাঞ্জাসাহেবের ঐতিহাসিক ঘটনাটিও।
কিন্তু শিহরিত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে, এই সব গল্প-কবিতা-নাটক সিনেমায় যা দেখেছি বা পড়েছি, তা আজ সব চাক্ষুষ দেখছি আমরা। তবে এখানেই শেষ নয়। এই করোনার পরিস্থিতির মধ্যেই এসে হাজির হল ঘূর্ণিঝড় ‘উমপুন’। আগে থেকেই জানা গিয়েছিল, এই ঝড়ের প্রকোপ বেশ ভালোই হবে। ঠিক, হলও তাই। যখন সে এল, মনে হল দরজা জানলায় কে যেন ধাক্কা মেরে বলছে, ‘আমি প্রলয়ের দেবতা, মৃত্যুর রাজা। তোমাদের বহুদিনের সঞ্চিত পাপের বিচার করতে এসেছি।’ তবে তাঁর বিচারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল বহু মানুষের ঘর-বাড়ি। লকডাউনের কারণে গ্রামের ঘরে ঘরে বহু কষ্ট ক’রে, লড়াই ক’রে, লাইনে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে, যে টুকু চাল-ডাল-আটা-গম জোগাড় করেছিল; এক রাতের মধ্যে তা সব ভেসে গেল। বাঁধ ভেঙে ধান ক্ষেতে ঢুকে পড়ল নোনা জল। একটু সময় পেরোতেই পুকুরে পুকুরে ভেসে উঠল বহু পরিশ্রমের পর চাষের মাছের মৃতদেহ। খাবার নেই, জল নেই, বাড়ির ছাদটুকুও নেই। এক রাতের মধ্যে সব কেড়ে নিয়ে গেল ঝড়ে।
পরের দিন নিজের চেনা শহরকে দেখে কান্না পাচ্ছিল। চারদিকে উপড়ে আসা গাছেদের শিকড়গুলোকে মনে হচ্ছিল, কে যেন অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। অধিকাংশ রাস্তা বন্ধ।
জল নেই, বিদ্যুৎ নেই, যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত। লকডাউন উপেক্ষা করেই রাস্তায় রাস্তায় লোক বেরিয়ে পড়েছে। খাবার জলটুকুও নেই অনেকের বাড়িতে।
মনে হচ্ছিল, এই মানুষ ডিজিটাল হওয়ার বড়াই করে। মহাকাশ নিয়ে চর্চা করে, মারণাস্ত্র বানায়।জঙ্গলের’ পর জঙ্গলে জ্বালিয়ে শহর বানায়। পাহাড়ের বুক ফাটিয়ে রাস্তা বানায়। পাহাড়ের শোভা দেখবে বলে বেআইনি ভাবে হোটেল খুলে বসে। আমরা কত উদ্ধত আজ!
কোনোভাবে একটা বাঘ বা অন্য কোনো বন্যপ্রাণী যদি লোকালয়ে ঢুকে পড়ে, এই মানুষই কিন্তু বনদপ্তরে অপেক্ষা না করেই সেই বাঘটাকে পিটিয়ে মারে। আবার এই মানুষই জঙ্গলে বেড়াতে গিয়ে কফির কাপ থেকে চিপসের প্যাকেট বা সিগারেটের টুকরো অবলীলায় ছড়িয়ে আসে।
আজ সেই মানুষ কোণঠাসা।
এটাই বোধহয় হওয়ার ছিল। প্রকৃতি আজ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে, ”তোমায় আমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ করে জন্ম দিলেও, মনে রেখো তুমি মানুষ আর আমি প্রকৃতি।” আর এই প্রকৃতিকেই দিনের’ পর দিন ধর্ষণ করেছি আমরা। আজ তাই আমরা গৃহবন্দী। আজ তাই আমরা ‘উমপুন’ জাতীয় ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প বা পঙ্গপালের সামনে অসহায়। প্রগতিশীল প্রযুক্তিও, এর সামনে নগন্য, তুচ্ছ।
তারপরেও মনে হচ্ছে, এই দুর্যোগের দিনে যে মানুষরা গৃহহীন হ’ল, যে চাষী ভাইদের চাষের জমি-পুকুর সব শেষ হয়ে গে’ল, তারা সবাই কেন এমন করে শাস্তি পেলো! সুন্দরবনের পশুপাখিরা তো কোনো দোষ করেনি। আসলে সত্যি, প্রকৃতির সিদ্ধান্তে ঈশ্বরও বোধহয় বিশেষ নাক গলান না। তাই বৃহত্তর পাপে, আজ সমগ্র জীবকূলকেই শাস্তি পেতে হচ্ছে।
সেই কারণেই আজ মানবিক হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ মনে রাখতে হবে আজ আমরা যারা নিরাপদ আশ্রয়ে বাড়িতে আছি, তাদের সব দাবি বা অসুবিধাগুলো সেই সব মানুষদের সামনে ভীষণ অর্থহীন, যাদের কাছে ঘর বা বাড়ি বলে আর কিচ্ছু নেই। আর সেই সঙ্গেই প্রকৃতির সামনে আসতে হবে নতশিরে। আজ যদি এই সমস্ত কিছু থেকে মানুষ শিক্ষা না নেয়, তবে সত্যি সত্যি এই সভ্যতার অন্তিম দিন হয়তো আসন্ন।
তাই আসুন, সকলে প্রকৃতি আর মানুষকে বিচ্ছিন্ন ভাবে না দেখে, একে অপরের বন্ধু হিসাবে দেখি। তবেই হয়তো এই সৃষ্টিকে কোনো এক মহাবিনাশের হাত থেকে আমরা বাঁচাতে পারবো।
নীলিমেশ রায় – বাংলার শিক্ষক, পাশাপাশি তিনি কবি, গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, গায়ক এবং চিন্তক। ভ্রমণ পিপাসু একজন মানুষ, এবং কথাবৃক্ষের প্রতিষ্ঠাতা ও সহ-সম্পাদক।