আগাগোড়াই যে ভারতবর্ষ ছিল একটি সমৃদ্ধশালী দেশ, এককালের সেই সমৃদ্ধশালী দেশ আজ পরিণত হয়েছে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে। ভারতবর্ষে ইউরোপীয়ানদের আগমনের পূর্বে, প্রায় সাড়ে তিনশো (১৫২৬-১৮৫৮) বছর ধরে চাতুর্যের সাথে শাসন চালিয়েছে ক্ষমতাধর মুঘল শাসকরা, এবং শুধু তাই নয়, ব্যবসা বাণিজ্য সম্পর্কে সুজ্ঞানী ছিল সেই শাসকদল। এই সময় ভারত ছিল অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ, যার ফলে ভারতের এই যুগকে স্বর্ণযুগও বলা হয়। তবে দিনে দিনে সাম্রাজ্যবাদ এবং লুন্ঠনের কারণে অর্থনীতিতে শুরু হয় পতন। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা যায় যে সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতির চার ভাগের এক ভাগ ছিল ভারতে। সেই সময় তা ছিল বিশ্বের ২য় সর্বোচ্চ যা কিনা গ্রেট ব্রিটেনের কোষাগারের থেকেও বেশি।

ইংরেজ আমলের আগে পর্যন্ত ভারতীয় বস্ত্র ও মশলা ছিল জগৎ বিখ্যাত। সিল্ক রুট এর কথা আমরা সবাই জানি। বাংলার মসলিন এবং অন্যান্য পণ্য সিল্ক রুট ধরেই মধ্য এশিয়া ও ইউরোপে যেত। কিন্তু ইংরেজ সহ ইউরোপীয়দের কাছে ভারত আবিষ্কৃত হয় পণ্যের কারণে। আরব বণিকদের ভারতীয় পণ্যের উপরে যে একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল তা নির্মূল করতেই ইউরোপীয়দের এদেশে আসা। ইউরোপীয়ান দেশগুলি ধীরে ধীরে ভারতে এসে তাদের ব্যবসা শুরু করে। সমগ্র বিশ্ব উন্নতির আলো দেখলেও আমাদের দেশে অর্থনীতির দ্রুত পতন দেখা দিয়েছিল। ভারতবর্ষ থেকে কম দামে কাঁচামাল কিনে বাইরের দেশে ভারতের বাজারের তুলনায় চড়া দামে সেই মাল বিক্রি করতে থাকায় ইংরেজরা আসার আগে ২০০০ বছর পর্যন্ত যে দেশ বিশ্বের মোট সম্পদের ২৫ শতাংশ অংশীদারিত্ব বহন করতো, ইংরেজরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার পরে সেই অংশীদারিত্ব নেমে আসে ৪ শতাংশে। এই পুঁজি ভারতের মধ্যে থাকলে আজ আমরা বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর অন্যতম হতে পারতাম। অর্থাৎ একথা পরিষ্কার যে ইংরেজ শাসনকালে, মাত্র ২০০ বছর সময়ের মধ্যে, বিশ্বের অর্থনীতির শীর্ষ অবস্থান থেকে সাম্রাজ্যবাদের কবলে পড়ে ভারতবর্ষের অধঃপতন ঘটে। কলোনিয়াল যুগের প্রভাবে রজু করা হয় নানান দায়ভার। খাজনা, আয়কর, সম্পত্তি কর ইত্যাদির প্রভাবে অর্থনীতিতে ধস নামে, একে একে থমকে যায় ভারতীয় কুটির শিল্প। তবে সুলতান মামুদ বা নাদির শাহের মত কয়েকজন লুণ্ঠনকারীকে বাদ দিলে ইংরেজদের মত এইভাবে দু’শো বছর ধরে ভারতীয় সম্পদ বিদেশে পাচার আর কোনো দেশ করেনি।

ইংরেজরা চেয়েছিল যে ভারতীয়রা তাদের শিক্ষায় শিক্ষিত হোক, যদিও তার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটা working class তৈরি করা এবং যার ফলে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত শিক্ষাগত কারণে কোনো বাজেট বরাদ্দের অভিপ্রায়ও তাদের ছিল না। ভারতীয় মূল্যবোধ, নীতিবোধ এবং শিক্ষাব্যবস্থা আঘাতপ্রাপ্ত হয় ব্রিটিশদের হাতে। শুরু হয় পাশ্চাত্য শিক্ষা। যদিও এই শিক্ষা ব্যবস্থার বেশ কিছু ভালো দিক রয়েছে। এই পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্বারা প্রত্যক্ষ প্রভাবে আমাদের দেশে এক নবজাগরণ ঘটে, ভারতীয়রা রপ্ত করে পাশ্চাত্য জ্ঞান, বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতি। পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে আলোকিত হয়ে মধ্যবিত্ত ভারতীয়রা – ইউরোপীয় সমাজ, রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার সঙ্গে পরিচিত হয় এবং নিজেরাও জাতীয়তাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। পাশ্চাত্য শিক্ষার সূত্রে ভারতীয়রা মিল, রুশো, স্টুয়ার্ট, বেন্থাম, ভলটেয়ার, কার্লমার্কস প্রভৃতি পাশ্চাত্য দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের প্রগতিশীল চিন্তাধারার সংস্পর্শে এসে উদারনৈতিক ভাবধারার সঙ্গে পরিচিত হয়। নানান দেশের বিপ্লব ও স্বাধীনতার ইতিহাস এবং তার সাফল্যের কথা পড়ে মধ্যবিত্ত ভারতীয় পেয়েছিল স্বাধীনতার জন্য লড়বার স্পৃহা। তাদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল ইংরেজদের অন্যায়, অবিচার ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর দৃঢ়তা। এর ফলস্বরূপ দেশবাসী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ব্রতী হয় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে। যে শাসন ব্যবস্থার গর্ব করত ইংরেজরা, ভারতীয়রা বুঝতে পারে, এটা নিছক ভাঁওতা। রাজনীতিবিদ ও শিক্ষাবিদ দাদাভাই নউরোজি একটি বই লেখেন ১৯০১ সালে, যার শিরোনাম Poverty and Un-British Rule in India ।

এরপর যদি বাংলার কথায় আসা যায়, তাহলেও দেখা যাবে যে বাংলার নবাবদের অপসারণের পর ইংরেজরা তাদের সম্পদ পাচার করা শুরু করে। বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা এবং লুটপাট চালিয়ে বাংলাকেও ঠেলে দেওয়া হয় দুর্ভিক্ষের পথে।ইংরেজরা নবাবের হাতে থেকে প্রশাসনিক দায়িত্ব নিজেদের অধীনে নিয়ে নেয়। এছাড়াও রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব স্বভাবতই ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে আর এই সুযোগে খাজনা আদায়ের নামে চলতে থাকে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার। এর ফল স্বরূপ দেখা দেয় বাংলার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর। এভাবে, কোম্পানির শাসনের সহযোগিতায়, খাদ্যশস্যের বাজার থেকে মুনাফা লুট এবং অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার কারণে জনমানুষের চরম ভোগান্তি হয়। দুর্ভিক্ষপীড়িত এলাকাগুলি হয়ে পড়ে জনশূন্য এবং জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। বিপুল পরিমাণে কমে যায় কৃষি উৎপাদন এবং ক্ষতিগ্রস্থ হয় সমস্ত দেশ। এর ফলে অন্তত এ কথা পরিষ্কার যে ভারতবর্ষের মতন কৃষি-প্রধান একটি দেশে, অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে কৃষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যা বিপুল ভাবে ব্যাঘাতপ্রাপ্ত হয় সেই সময়।
ভারতীয় সমাজে ধর্মকে মৌলিক বিভাজনের নেপথ্য-কারণ হিসেবে ব্যবহার করে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বড় পরিসরের ধর্মীয় দাঙ্গার বীজ বপন করে ইংরেজরা। যে সমস্যাগুলো একসময় ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক রূপে নিছক সামাজিক ভাবে সামলে যেত, সেই সমস্যা পরিণত হতে থাকে মর্মান্তিক সমস্ত দাঙ্গায়।
ভারতীয় রেল যোগাযোগের পরিকল্পনা প্রথম করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। যদিও তাদের নিজেদের ব্যবসার সুবিধার্থেই তারা এই কথা চিন্তা ভাবনা করে। ইংরেজ অংশীদাররা ভারতীয় রেল যোগাযোগে বিনিয়োগের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করেছিল। সরকার রেল পরিকল্পনার শুরু থেকেই কথা দিয়ে রেখেছিল যে বিনিয়োগকারীদের তারা তাদের বিনিয়োগের দ্বিগুন পরিমান অর্থ ফিরিয়ে দেবে। যদিও সেই অর্থ পুরোপুরি ছিল ভারতীয় এবং স্বভাবতই রেল যোগাযোগের কারণবশত ভারতীয় করদাতাদের অর্থে ফুলে-ফেঁপে উঠেছিল ব্রিটেনের কোষাগার। যদিও আমাদের দুর্ভাগ্য যে সেই সময় ভারতীয় নাগরিকদের জন্য ট্রেনে বরাদ্দ ছিল তৃতীয় শ্রেণীর কামরা, যেগুলোতে কাঠের বেঞ্চির অতিরিক্ত আর কোনো সুযোগ-সুবিধাই দেওয়া হত না। এছাড়াও রেলে চাকরি দেয়া হতো না ভারতীয়দের। সেই চাকরি বরাদ্দ থাকতো সাদা চামড়ার মানুষদের জন্য। ব্রিটিশদের এই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল কয়লা, লোহা এবং তুলো জাতীয় কাঁচামাল বিভিন্ন বন্দর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাতে ব্রিটিশরা জাহাজে করে সেগুলো খুব সহজেই নিজেদের দেশে পাচার করতে পারে।

ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার বছরের সংস্কৃতি। এ দেশের ঝুলিতে আছে যুগান্তকারী সমস্ত আবিষ্কার, বিশ্ব শ্রেষ্ঠ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্বমানের উৎপাদন। তবে দীর্ঘ এত বছর গণতন্ত্র অনুশীলন করার পরেও আমাদের রাজন্যপ্রেম ও রাজভক্তি যায়নি, বরং বেড়েছে। শিরদাঁড়া সোজা করে লড়ে যাওয়া ভারতবাসী নিজেকে স্বাধীন দাবি করার পাশাপাশি আজও রাজার কাছে মাথা নীচু করে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে যে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন – “ভারতবর্ষে ইংরেজদের আগমন ঈশ্বরের আশীর্বাদ”। হ্যাঁ একথা হয়তো ঠিক যে ব্রিটিশদের অত্যাচার থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু স্বাধীন হয়ে পরাধীনতা স্বীকার করার থেকে ঢের সম্মানের হলো পরাধীন হয়ে পরাধীনতা স্বীকার করে থাকা। ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে কথিত আছে, যে এক প্রজন্ম সম্পত্তি তৈরি করে, সঞ্চয় করে আর পরের তিন প্রজন্ম তা ধ্বংস করে। আমরাও কোথাও এই হাজার হাজার মানুষের আত্মবলিদানের ফলে লাভ করা স্বাধীনতাকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি না তো..? আশা করি আমরাও সেই কুলাঙ্গার সন্তানে পরিণত হচ্ছি যারা কিনা নিজেদের পায়ে কুরুল মারার মতন করে নিজেদের দেশকেই অন্ধকারে ঠেলে দেব। মনে রাখবেন, আমরা ‘ভারতবাসী’। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, একক ‘ভারত’ ধারণাটির জন্ম ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের আমাদেরকে দেওয়া সবচেয়ে বড় অবদান। কিন্তু এই ধারণা কে প্রতিপালন করাই আজ আমাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।

Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.