জঙ্গল প্রেমী মানুষেরা দেশে বিদেশে অনেক জঙ্গলে চষে বেড়ান, তবে পশ্চিমবঙ্গে অপূর্ব একটি লুকোনো হীরের সন্ধান দিতে চাই আমি।
জলদাপাড়া ন্যাশনাল পার্কের এন্ট্রি গেট থেকে ৮ কিমি ভিতরে অবস্থিত হলং বাংলো, যা জঙ্গল প্রেমীদের কাছে এক কথায় স্বর্গ। West Bengal Forest Department থেকে অনলাইনে এই বাংলোটি বুক করা সম্ভব। হলং এর নিকটবর্তী রেল স্টেশন হাসিমারা। আমি দুবার এই বাংলোতে থেকেছি। দুবারের অভিজ্ঞতাই অসাধারণ। জঙ্গলের একটা অদ্ভুত শব্দ আছে চোখ বুজে কান পাতলেই সেটা শোনা সম্ভব। এখানে থাকার বাড়তি সুবিধে গুলো হল সকালে প্রথম হাতি সাফারিতে বেরোনোর সুযোগ, বিকালে কোর জোনে জিপ সাফারি ও রাত্রে স্পট লাইট ফেলে বাংলোর সামনে নাইট সাইটিং এর ব্যবস্থার রোমাঞ্চ। আর শেষে সব থেকে বেশি উপভোগ্য হল ওখানকার আতিথেয়তা।

তিন তলা বাংলোটিতে আমাদের দুবারই ঘর ছিল দোতলায়। জঙ্গলে ঘেরা বাংলোটির একদিক দিয়ে বয়ে চলেছে হলং নদী। বাংলোয় ঢোকার মুখেই কাঠের ব্রিজ নদীর ওপর ও তারপর নুড়ি পাথর বিছানো রাস্তা আপনাকে সহজেই সবুজ রঙের বনবাংলোতে পৌঁছে দেবে। কপাল ভালো থাকলে বাংলোয় ঢোকার সময়ই দেখা পাওয়া যেতে পারে একশৃঙ্গ গন্ডারের, যেন তার রাজ্যে আপনাকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত।
প্রথমবার আমরা পৌঁছে যখন সবে রিসেপশনে চেক ইন করছি তখন ওখানকার ম্যানেজার আমাদের বললেন, ‘আপনারা একটু বাংলোর পিছন দিকটা দেখে আসুন একটা গন্ডার বেরিয়েছে’। আমরা গিয়ে দেখি একটা গন্ডার একেবারে বাংলোর কাছ ঘেঁসে দাড়িয়ে আছে। বাংলোর পিছনে হলঙ নদীর বাঁধানো ঘাট পেরিয়ে গন্ডারটি বাংলোর দিকের পারে চলে এসেছে। এর আগে গন্ডার দেখেছি বটে তবে এত কাছ থেকে নয়।

দ্বিতীয় বারও আমাদের গাড়ি যখন প্রায় আট কিমি পেরিয়ে বাংলোর সামনে ব্রিজ পেরোচ্ছে আমাদের ড্রাইভার আমাদের দেখালেন বাঁ দিকে একটি গন্ডার তখন নদী পার হচ্ছে। বাংলোর পিছনে বাঁধানো ঘাটের ওইপারে কিছুটা ফাঁকা জায়গা তার পর শুরু হচ্ছে ঘন জঙ্গল। ফাঁকা জায়গাটায় রয়েছে সল্ট পিট। প্রতিদিন দুপুর নাগাদ বনকর্মীরা ওই সল্ট পিটে নুন দিয়ে আসেন।
তার কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হয় আসল সিনেমা। বেশ কিছু বন্য প্রাণী সম্বর, হরিণ, হাতি, ইন্ডিয়ান গউর, গন্ডার, ময়ূর এমনকি কিছু পাখিও আসে নুন খেতে, নিজেদের দেহে সোডিয়ামের চাহিদা মেটাতে। দুপুরের খাওয়া সেরে অনায়াসে বাঁধানো ঘাটে বসে প্রকৃতির এইসব কুশীলবদের কীর্তি কলাপ দেখতে দেখতে মন ভরে যায়। নুন খাওয়া নিয়ে তাদের প্রতিযোগিতা দেখার মত।
এমনকি বাংলোর পিছনের দিকে যে ঘর গুলো রয়েছে তাতে বসে জানলা দিয়েও এই দৃশ্য উপভোগ করা যাবে।
তারপর বিকেল হলে বেরিয়ে পরতে হবে সেই ব্রিজটির উদ্দেশ্যে যেখানে দাঁড়িয়ে দেখতে পাবেন হাতি স্নান। যে হাতিরা রোজ ভোর বেলা সাফারিতে যায় তাদের মাহুতরা বিকেলে তাদের নিয়ে আসেন ওই নদীতে স্নান করতে। এও এক স্বর্গীয় দৃশ্য বটে। দুষ্টু পুঁচকে হাতিগুলো দলছুট হয়ে পার থেকে অনেক দূরে এসে এপাং অপাং ঝপাং করে জলে খেলা করে। তবে ঘড়ির দিকে খেয়াল রাখা আবশ্যক কারণ সূর্যাস্তের পরে পায়ে হেঁটে জঙ্গলের আসে পাশে হেঁটে চলে বেড়ানো নিষেধ। জঙ্গলের নিয়ম অমান্য করা চলে না।
এ ছাড়াও বিকালে জীপে করে যাওয়া যায় ওয়াচ টাওয়ার এ। সেখানে বসে জঙ্গলের নিস্তব্ধতাকে সঙ্গী করে অপেক্ষা করতে হয় কোনো বন্য প্রাণীর আগমনের। ওয়াচ টাওয়ারে বাড়তি পাওনা হল উঁচু থেকে পুরো জঙ্গলের একটা বার্ডস আই ভিউ পাওয়া। তারপর সন্ধ্যে নামলে চা জল খাবার সহযোগে বসতে হবে বাংলোর দোতলার কমন রুমে। সেখানে বন দপ্তরের কর্মীরাই স্পট লাইট নিয়ে আসেন, ঘরের আলো নিভিয়ে চোখ রাখা হয় নদীর ওপারে সল্ট পিটের দিকে। তারপর একে একে আসতে শুরু করে দুপুরের সেই কলাকুশলীরা।

প্রথমবার যখন আমরা গিয়েছিলাম ওখানকার লোকেরা আমাদের ওই রাতে নিয়ে গিয়েছিলেন নদীর ঘাটে। সেখান থেকে একদম কাছে দেখা যাচ্ছিল নদীর ওই পারে আসা বন্য প্রানীদের। স্পট লাইট ফেলে দিচ্ছিলেন ওনারা আমরা ছবি তুলছিলাম। মনে হচ্ছিল চোখের সামনে ডিসকভারি চ্যানেল বা অ্যানিমাল প্ল্যানেট দেখছিলাম লাইভ। চারিদিক এতটাই নিস্তব্ধ যে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক আর নিজেদের নিশ্বাস ছাড়া আর কিছু শোনা যায়না। মাঝে মাঝে হাতির ডাক, গন্ডারের হুংকার শুনতে পাচ্ছিলাম।
আরো একটা জিনিস খুব মন কেড়ে ছিল আমাদের, ওখানকার কর্মীদের উৎসাহ। আমাদের সাইটিং করানোর জন্যে ওনাদের চেষ্টা দেখে আমরা অবাক হচ্ছিলাম। আমরা দেখেছিলাম গন্ডার নদী পার হচ্ছে ওই রাতের বেলা, দেখেছিলাম হাতির দল এসেছে নুন খেতে, আবার নুন খাওয়া নিয়ে দুই গন্ডারের ঝামেলার বিরল দৃশ্যও দেখেছিলাম।
এই সব দেখে মন ভরিয়ে এবার পেট ভরানোর পালা। ডাইনিং হলটি মূল বাংলোর সঙ্গে একটা কাঠের রেলিং দেওয়া করিডোর দিয়ে যুক্ত। খাওয়া দাওয়া সেরে আপনি যখন হলের বাইরে হাত ধুতে যাবেন, একবার ঘাড় ঘোরালে হয়ত দেখবেন, যে গন্ডারটা তখন নদী পেরিয়ে এইপারে মানে বাংলোর দিকে এল, সে দাঁড়িয়ে আছে মাঠের মধ্যে গাছের নিচে আপনার থেকে বড়জোর দশ বারো হাত দূরে। তারপর আপনি ভয় পেয়ে ঘরের দিকে যেই যেতে যাবেন করিডোর পেরিয়ে দেখবেন সিড়িতে ওঠার মুখেই দেওয়ালে একটা প্রাণী। যদি ভেবে থাকেন টিকটিকি বা গিরগিটি জাতীয় একধরনের প্রাণী ভুল করবেন এটা গেকো বা তক্ষক। তারপরেও যদি আপনার হৃৎপিণ্ড যথেষ্ট শক্তিশালী হয় তাহলে আপনি আবার যেতেই পারেন নদীর ধারে স্পটিং করতে। আর যদি একান্তই না যেতে চান ঘরে বা কমন রুমে বসে প্রান আর চোখ ভরে দেখুন।
তবে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া ভালো যদি আপনি পরের দিন ভোরে এলিফেন্ট সাফারিতে যেতে চান। ভোরে উঠে হাতির পিঠে চড়ে যাওয়া যাবে জঙ্গলের একদম ভিতরে। সেখানে গন্ডারের স্নানের দৃশ্য,ময়ূরের পেখম মেলা নাচ,হরিণের ঘুম ভাঙ্গা এসব দেখতেই পারেন। আর বাড়তি পাওনা হিসেবে পাবেন বিভিন্ন পাখি- ধনেশ, গ্রীন বি ইটার, গ্রীন পিজিয়ন, এগ্রেট আরো অনেক। আমাদের সাফারির সময় একটি গন্ডার আমাদের তাড়া করেছিল তার বাচ্চাকে সুরক্ষিত রাখার জন্যে। যেকোনো প্রাণীই সব সময় চায় নিজের বাচ্চাদের সুরক্ষিত রাখতে তাই বাচ্চা সঙ্গে থাকলে তারা অনেক বেশি হিংস্র হয়ে ওঠে।

আমি ওখানকার এক কর্মীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে বন্য প্রাণীরা কখনো আক্রমণ করে কিনা। এর উত্তরে ওই কর্মী আমাকে বাংলোর দেওয়ালে লাগানো একটা বোর্ড দেখান যাতে লেখা ছিল- আপনি যখন জঙ্গলে প্রবেশ করেন আপনি হয়তো কিছু দেখতে পান না তবে ভুলে যাবেন না যে অনেকগুলো চোখ আপনাকে দেখছে এবং তারা অপেক্ষা করছে আপনি কখন ওদের এলাকা ছেড়ে যাবেন। তার মানে আমরা যদি ওদের বিরক্ত না করি ওরা আমাদের ক্ষতি করবেনা। যারা জঙ্গলে যেতে চান তাদের সকলের বিনোদনের সঙ্গে সঙ্গে বন্য প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াও একান্ত প্রয়োজনীয়।
সবশেষে বলি হলং এ রাত্রিবাস যেকোনো ভ্রমনপিপাসু মানুষের এক অনন্য অভিজ্ঞতা যা নিজে অনুভব করতে হবে কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে ভাষায় ব্যক্ত করা প্রায় অসম্ভব। আমি বার বার ফিরে যেতে চাই জঙ্গলে আর এই বিশালতার মাঝে নিজেকে হারাতে চাই।
লেখক পরিচিতিঃ
সম্পূর্ণা মখার্জী একজন ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি এবং পেশায় শিক্ষিকা । নতুন জায়গা থেকে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তাঁর লেখনীর মাধ্যমে সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়াই তাঁর অন্যতম নেশা।
All rights reserved © Kothabriksha 2020