মাছের প্রসঙ্গে আসলেই অবধারিতভাবে চলে আসে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এর নাম। বাঙালি এই ধ্রুপদ বাদককে তার অবাঙালি বন্ধুরা উপহাস করে বলতেন,
“মচ্ছিকে পানি পিনেওয়ালা”। সেই কথার কোনো উত্তর না দিয়ে অসম্ভব আত্মপ্রত্যয়ে তিনি বাম হাতে সরোদ বাজানো অভ্যাস করলেন। জয় করলেন ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত জগৎ।
মনসা মঙ্গলের দুই কবি বিজয়গুপ্ত ও দ্বিজ বংশীদাস যথাক্রমে বরিশাল ও ময়মনসিংহের মানুষ ছিলেন। বেহুলার বিবাহের রন্ধন তালিকা বর্ণনায় পনেরো শতকের কবি বিজয়গুপ্ত তার কাব্য লিখেছিলেন,
“মাগুর মৎস দিয়া রান্ধে গিমা গাচ গাচ,
ঝাঁজ কটু তৈলে রান্ধে খরসুন মাছ।
ভিতরে মরিচ গুঁড়া বাহিরে জড়ায় সুতা
তেলে পাক করি রান্ধে চিংড়ির মাথা॥”
আবার ষোলো শতকের কবি দ্বিজ বংশীদাস
লিখেছিলেন,
“পাবদা মৎস দিয়া রান্ধে নালিতার ঝোল,
পুরান কুমড়া দিয়া রোহিতের কোল।”
তাদের লেখায় উঠে এসেছে রুই, বোয়াল, খলসে, ট্যাংরা, রিঠা, চিংড়ি, ইলিশ, মাগুর, শিং, মৌরলা, শোল প্রভৃতি মাছের নাম।
নদীমাতৃক বাংলা ও ভূমির ফসলে বাঙালি ভাতে মাছে দিন কাটিয়ে দিতে পারে। ধান ও মাছের এই সহজলভ্যতার কারণেই জীবনযাপনে কিংবা মনস্তত্ত্বে ওতপ্রোতোভাবে জড়িয়ে গেছে এই দুটি জিনিস। তাই হয়তো বাঙালি সমাজে ধান হলো ধনসম্পদ ও মাছ হলো উর্বরতার প্রতীক।
চন্ডীমঙ্গলের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কাব্যে পাওয়া যায়,
দেবীর আদেশে লহনা নির্বাসিতা খুল্লনাকে বাড়িতে ফিরিয়ে স্নান করিয়ে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন রেঁধে খাওয়ান। সে প্রসঙ্গে তিনি লেখেন,
“কটু তৈলে রান্ধে বামা চিতলের কোল
রুহিতে কুমড়া বড়ি আলু দিয়া ঝোল।
কটু তৈলে কই মৎস্য ভাজে গন্ডা দশ।
মুঠো নিথারিয়া তথি দিল আদারস।”
এমনকি খাদ্য তালিকায় ‘শকুল মৎস্যপোনা’ বা শোল মাছ ও বাদ যায়নি।
রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের “অন্নদামঙ্গল” এ ভবানন্দ মজুমদারের স্ত্রী পদ্মমুখী ব্রাহ্মণভোজনের জন্য আম দিয়ে শোল মাছ, বাচা মাছের ঝোল, ভেটকি, খয়রা মাছ ভাজা রান্না করেন। তিনি আরও লেখেন,
“নিরামিষ তেইশ রান্ধিয়া অনায়সে।
আরম্ভিলা বিবিধ রন্ধন মৎস মাসে।”
অর্থাৎ সমস্ত নিরামিষ রান্নার পর শুরু হয় মৎস রান্না।
ডাকের বচনে ও মাছের কথা আমরা দেখতে পাই,
“পলতা শাক রুহি মাছ।
বলে ডাক বেঞ্জন সাছ॥
মদগুর মৎস্য দাএ কুটিয়া।
হিঙ্গ আদা লবণ দিয়া॥
তেল হলদি তাহাতে দিব।
বলে ডাক ব্যঞ্জন খাব॥
পোনা মাছ জামিরের রসে।
কাসন্দি দিআ যেজন পরশে॥”
খনার বচনেও মাছ জায়গা করে নিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে,
“মাছের জলে লাউ বাড়ে
ধেনো জমিতে ঝাল বাড়ে।”
কয়েকদিন আগেই জানতে পারলাম মাছের মেলার কথা। মাঘবরণ করে দেবানন্দপুরের কেষ্টপুরে এই মেলা হয়। এই মেলা ৫১৩ বছরের পুরোনো। চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যতম প্রধান শিষ্য রঘুনাথ দাস গোস্বামীর বাড়িতে বসা এই মেলাকে কেন্দ্র করে নানান গল্প কথা প্রচলিত। এই রঘুনাথ দাস গোস্বামী ছিলেন, আদিসপ্তগ্রামের রাজার একমাত্র পুত্র। সংসারের সকল মায়া, ভোগ বিলাসিতা ত্যাগ করে তিনি মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেবের অনুগামী হয়েছিলেন। প্রায় নয় বছর পর গৃহে ফিরলে তাকে পরীক্ষা করার জন্য ভক্তরা কাঁচা আমের ঝোল ও ইলিশ মাছ খেতে চায়। তার আদেশে বাড়ীর পাশের জোড়া আম গাছ থেকে আম ও পাশের পুকুর থেকে মাছ ধরা হয়েছিলো, তখন থেকেই সম্ভবত এই মেলার সূচনা হয়।
ইতিহাসের পাতাও মাছ কে ভুলতে পারেনি। মুঘলরাও এদেশে এসে মাছের প্রেমে পড়েছিলেন। কথায় আছে “মাছের রাজা রুই, শাকের রাজা পুঁই।”
আসলে ইলিশের স্বাদ নিয়ে কিছুই বলার না থাকলেও রুই মাছের মতো নানা রকমভাবে ইলিশকে রান্না করা যায় না, আর কৌলিন্য বুঝতে পেরেছিলেন মুঘল সম্রাটরা। তাই বাদশাহরা শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ “মাহি মারাতিব” পুরস্কার দিতেন। এই মাহি বা মাছ হলো রুই মাছ। ধাতুর তৈরি মাছের প্রতিকৃতিযুক্ত ফলক দান করে সম্মানিত করা হতো বীরদের।
স্বয়ং কবি ঈশ্বরগুপ্ত ও মাছের মহিমা বোঝাতে লিখেছিলেন,
“ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল
ধানে ভরা ভূমি তাই মাছ ভরা জল।”
আবার তিনিই তোপসে মাছের রূপ বর্ননায় লিখেছেন,
“কনককান্তি কমনীয় কায়,
গালভরা গোপদাড়ি তপস্বীর প্রায়।”
(চলবে)
লেখক পরিচিতি : সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি আগ্রহে কলমে ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি, নানান দেশের খাদ্যাচরণ, ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ রয়েছে। বিভিন্ন দেশের প্রকৃতি ও ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকে গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকের জন্য রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।
Copyright © Kothabriksha 2021, All Rights Reserved