ভোরবেলার পার্কস্ট্রীট। সেদিন তখনও প্রথম ট্রাম চালু হয়নি রাস্তায়। আধো অন্ধকারে ৪৯ নম্বর পার্ক স্ট্রীটের বাড়িটা অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বাড়ির তেতলার ঘরে, হঠাৎ পায়ের কাছে কিসের যেন ছোঁয়া পেয়ে ঘুম ভাঙল রবির। অবাক হয়ে দেখলেন, প্রণাম করে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে ভাগ্নি সরলা। পায়ের কাছে দেওয়া রয়েছে বকুল আর বেল ফুলের গাঁথা মালা, সঙ্গে একজোড়া ধুতি চাদর। উপলক্ষ, রবিমামা’র জন্মদিন। উৎসাহী সরলার উদ্যোগে সেই শুরু হল জন্মদিন পালন – ২৫ শে বৈশাখ।

মহর্ষিভবনের সীমিত অন্তঃপুরে বড় হয়ে ওঠা বালকটি সেদিন পূর্ণ করেছিলেন ২০ বছর বয়স। কালের পরিক্রমায় যিনি একদিন বিশ্বকবি হয়ে উঠবেন, তাঁর কাছে হয়তো এ উৎসবের গুরুত্ব কিছু অন্যরকমই ছিল। তাই দেখি, এ ঘটনার ১৯ বছর পরে ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে জন্মদিন উপলক্ষে রচনা করছেন গান। পরে তা সঙ্কলিত হল ‘কল্পনা’ কাব্যগ্রন্থে – ‘জন্মদিনের গান’ শিরোনামে।
“ভয় হতে তব অভয়মাঝে
নূতন জনম দাও হে!
দীনতা হইতে অক্ষয় ধনে,
সংশয় হতে সত্যসদনে,
জড়তা হইতে নবীন জীবনে
নূতন জনম দাও হে!….”
শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে কবির জন্মদিন উৎসব আকারে পালিত হওয়া শুরু হয় ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে। এর ঠিক আগের বছর ৩১শে বৈশাখ প্রকাশ পায় ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকটি। সে বছর জন্মদিন পালন হয়েছিল কিনা জানা যায় না, কিন্তু প্রায়শ্চিত্তের ধনঞ্জয় চরিত্রে যেন জন্মলাভ করে কবির এক দ্বিতীয় সত্তা। উৎসবের আবহ, যা পরবর্তীকালে এই বিশেষ সময়টিতে আশ্রমে সৃষ্টি করেছে অনেক আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্ত। তাই বলা যায়, সময়কালের নিরিখে প্রায়শ্চিত্ত ছিল এই উৎসব যাপনের এক অন্তরঙ্গ অংশীদার।
এ নাটকেরই কিছু গান পরে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ‘The Gardener’ নামে একটি ইংরাজী কবিতা সঙ্কলনে প্রকাশ পায়। যেমন – “না বলে যেওনা চলে..” গানটি
“Do Not Go, My Love, without asking my leave
I have watched all night and now my eyes are heavy with sleep
I start up and stretch out my hand to touch you
I ask myself, “Is it a dream?”
Could I but entangle your feet with my heart and keep you close to my breast!
Do not go, my Love, without asking my leave.”
১৯১১ খ্রিস্টাব্দে জন্মোৎসব উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে অভিনীত হল ‘রাজা’ নাটক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরদা’র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। স্মৃতিচারণায় সীতা দেবী লিখেছেন – “ ঠাকুরদা সাজিতে তাঁহাকে বিশেষ কষ্ট পাইতে হয় নাই। সদাসর্বদা যে গেরুয়া রঙের পোষাক পরিতেন তাহার উপর ফুলের মালা পরিয়া তিনি রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করিলেন। ঠাকুরদা যেখানে রাজসেনাপতির বেশে আবির্ভূত হইলেন, সেখানে অবশ্য বেশের পরিবর্তন ঘটিল। সাদা রেশমের পোষাকের উপর চওড়া লাল কোমরবন্ধ পরিয়া তিনি বাহির হইলেন। …আত্মগোপন করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল। যদিও তিনি অতি উৎকৃষ্ট প্রথম শ্রেণীর অভিনেতা ছিলেন। আকাশের সূর্যকে যেমন সাজাইয়া তারকার মূর্তি ধরানো যায় না, তাঁহাকেও তেমনি অন্য কাহারো মূর্তি ধরানো যাইত না”। এ বছরেই জন্মোৎসবের দিনে অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যায় কবি স্বকন্ঠে গাইলেন এই গানটি –
“ওই আসনতলের মাটির পরে লুকিয়ে রব
তোমার চরণ ধুলায় ধুলায় ধূসর হব…”
পরের বছর উৎসব শুরু হয় ক্রীড়াপ্রতিযোগিতা দিয়ে। আশ্রমের ছাত্ররা অভিনয় করল ‘বিনিপয়সার ভোজ’ এবং ‘কলির ভগীরথ’ নাটকে। অজিতকুমার চক্রবর্তী পাঠ করলেন ‘রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধটি। এছাড়া গান তো ছিলই। যেমন –
“আমারে তুমি অশেষ করেছ….” , “এই লভিনু সঙ্গ তব….” প্রভৃতি।

কবির বাষট্টি বছরের জন্মদিনে পাই এক অবিস্মরণীয় কবিতা। পূরবী কাব্যের ‘পঁচিশে বৈশাখ’।
“রাত্রি হল ভোর
আজি মোর
জন্মের স্মরণপূর্ণ বাণী
প্রভাতের রৌদ্রে লেখা লিপিখানি
হাতে করে আনি
দ্বারে আসি দিল ডাক পঁচিশে বৈশাখ।
হে নূতন
দেখা দিক আরবার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।
আচ্ছন্ন করেছে তারে আজি
শীর্ণ নিমেষের যত ধূলিকীর্ণ জীর্ণ পত্ররাজি।
মনে রেখো হে নবীন,
তোমার প্রথম জন্মদিন ক্ষয়হীণ………হে নূতন হোক তব জাগরণ ভস্ম হতে দীপ্ত হুতাশন…”
১৯২৬ এ শান্তিনিকেতনে অভিনীত হল ‘নটীর পূজা’। স্বল্পপরিসর এই নাটকটি সম্পর্কে রবীন্দ্রজীবনীকার বলেছেন- “বিশেষ idea বা আদর্শের জন্য লোকে আত্মাহুতি দিয়াছে, তাহার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল নহে কিন্তু অহিংসাকে ধর্ম হিসাবে গ্রহণ ও পালনের উদাহরণ দুর্লভ। রবীন্দ্রনাথ কলিকাতায় কয়দিন পূর্বে হিন্দু মুসলমানের যে ধর্মোন্মত্ততা ও হিংস্রতা দেখিয়াছিলেন তাহার অভিঘাত প্রেরণা এই রচনার মধ্যে আছে বলিয়া আমাদের মনে হয়…”
“আজ মম জন্মদিন। সদ্যই প্রাণের প্রান্তপথে
ডুব দিয়ে উঠেছে সে বিলুপ্তির অন্ধকার হতে
মরণের ছাড়পত্র নিয়ে। মনে হতেছে কী জানি
পুরাতন বৎসরের গ্রন্থিবাঁধা জীর্ণ মালাখানি
সেথা গেছে ছিন্ন হয়ে; নবসূত্রে পড়ে আজি গাঁথা নব জন্মদিন।
জন্মোৎসবের এই যে আসন পাতা
হেথা আমি যাত্রী শুধু, অপেক্ষা করিব, লব টিকা
মৃত্যুর দক্ষিণ হস্ত হতে, নূতন অরুণলিখা
যবে দিবে যাত্রার ইঙ্গিত…”

সেঁজুতি কাব্যের এই কবিতা রচিত হয় ২৫শে বৈশাখ ১৩৪৫ অর্থাৎ ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কালিম্পং এ। এর কিছু পরেই সৃষ্টি হয় এই গানটি-
“প্রথম যুগের উদয়দিগঙ্গনে
প্রথম দিনের উষা নেমে এল যবে
প্রকাশ পিয়াসী ধরিত্রী বনে বনে
শুধায় ফিরিল সুর খুঁজে পাবে কবে ।।
এস এস সেই নবসৃষ্টির কবি
নবজাগরণযুগ প্রভাতের রবি —
গান এনেছিলে নব ছন্দের তালে
তরুণী ঊষার শিশির স্নানের কালে
আলো-আঁধারের আনন্দ বিপ্লবে…”
সময়টা ১৯৪০। সে বছরের জন্মদিনে কবি ছিলেন মংপুতে। এক অভিনব জন্মোৎসব পালন করেছিল সেখানকার স্থানীয় মানুষেরা। মৈত্রেয়ী দেবী লিখেছেন “বিকেল বেলা দলে দলে সবাই আসতে লাগল। আমাদের পাহাড়ী দরিদ্র প্রতিবেশী, সানাই বাজাতে লাগল…ঠেলা চেয়ারে করে বাড়ির পথ দিয়ে ধীরে ধীরে ওঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল – দলে দলে পাহাড়ীরা প্রণত হয়ে ফুল দিচ্ছিল…তিব্বতীরা পরালো খর্দা গাছের সুতোয় বোনা স্কার্ফ, যা ওরা লামাদের পরায়। ফুলে প্রায় আবৃত হয়ে গিয়েছিলেন। শংখধ্বনির মধ্যে শিলাতলে এসে বসলেন, তিব্বতী আর ভূটানীরা শুরু করল তাদের জংলী তান্ডব নাচ…”

‘জন্মদিন’ নামে তিনটি কবিতা এ পর্বে রচিত হয়েছিল তার একটিতে ভাষা পেয়েছে এই অভিজ্ঞতা –
“অপরাহ্ণে এসেছিল জন্মবাসরের আমন্ত্রণে পাহাড়িয়া যত।
একে একে দিল মোরে পুষ্পের মঞ্জরী নমস্কার সহ।
ধরণী লভিয়াছিল কোন ক্ষণে প্রস্তর আসনে বসি
বহুযুগ বহ্নিতপ্ত তপস্যার পরে এই বর,
এ পুষ্পের দান মানুষের জন্মদিনে উৎসর্গ করিবে আশা করি…”
১৯৪১ এর ২৫ শে বৈশাখ। কবির শেষ জন্মদিন। প্রিয় শিষ্য শান্তিদেব ঘোষের অনুরোধে সুরারোপ করলেন ১৯ বছর আগে লেখা ‘পঁচিশে বৈশাখ’ কবিতার অংশবিশেষে। রবিপরিক্রমার দিনান্তবেলায় প্রাপ্ত এই গানখানি, অগণন মানুষের সহস্র বছরের সারস্বত সাধনার, এক অপরিমেয় নির্মাল্য হয়ে রইল।
“হে নূতন,
দেখা দিক আর বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ।।
তোমারও প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন।
রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন।
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময়।
উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে
চির নূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ।।”

লেখক পরিচিতি :- মহুয়া চক্রবর্তী পেশায় কলকাতার বিদ্যভারতী গার্লস হাই স্কুলের সঙ্গীত শিক্ষিকা। তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের গবেষক। রবীন্দ্রনাথের গান ও তাঁর সামগ্রিক সাহিত্য চর্চাই তার নেশা।
Copyright © Kothabriksha 2021, All Rights Reserved.