অনেকদিন লেখালিখি হচ্ছে না, প্রচুর ভ্রমণের ছবি আর অভিজ্ঞতা জমে রয়েছে। এই লকডাউন আর করোনার জেরে নিজের মনকে বাঁচিয়ে রাখার মূল মন্ত্রগুলোই আমরা দিনে দিনে ভুলে যাচ্ছি। বেড়াতে যেতে না পারার কষ্টটা, পুরোনো জমে থাকা ভ্রমণকাহিনী লিখেই খানিকটা উসুল করে নিলাম।

২০১৯ সালের পুজোর আগ দিয়ে বার বার মনে হচ্ছিল শহরের এত শব্দ আর ভালো লাগছেনা, এত কোলাহল অসহ্য হয়ে উঠছিল আমার কাছে। চারিদিক যেন কেমন অর্থহীন হাহাকারে মেতে উঠেছে। উৎসবের উত্তেজনায় উদ্বেল মানুষজন। যেন উৎসব, পার্বণ নিংড়ে ছিবড়ে করে দিয়ে চেটেপুটে সবটুকু সাবাড় করতে হবে। শব্দ, শব্দ, চারিদিকে শব্দ, কোলাহল, হইচই আর চিৎকার। প্রাণের তখন একটু নীরবতা চাই, চাই একটু নিজস্ব সময়। জানিনা কিভাবে সব স্তব্ধ করব। কিভাবে প্রতিবাদ করব, তাও জানা নেই। প্রতিবাদ করার ইচ্ছেও নেই কারণ শারদোৎসবের দিনগুলো আমার কাছেও বছরের অতন্ত্য প্রিয় দিনগুলোর অন্যতম। তবে আজকাল মানুষের যেন সবকিছুরই একটু বাড়াবাড়ি।

তাই আর দেরি না করে ভাবলাম বেশ, হাঁটা যাক তবে সেই পালিয়ে যাওয়ার অজানার পথে। অজানার পিছনে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম এক নদীর ধারে। না, সেদিন সেখানে ছিলনা কোনও চিৎকার, কোলাহল বা অর্থহীন কোনো শব্দ। সত্যিই ছিল না কি শব্দ? শব্দ ছিল। কিন্তু সে শব্দ চিৎকার নয়। সে শব্দ কোলাহল নয়। তবে কি…? সেই শব্দ নদীর বয়ে চলার শব্দ, খরস্রোতা নদীর বেগে ভেসে আসা গান। সেদিন সত্যিই একাত্ম হয়েছিলাম নদীর সঙ্গে।

পাকদণ্ডী বেয়ে নেমে আসছিল গাড়ি, পেডং থেকে রংপোখোলার রাস্তা ধরে। পাড়ি দিয়েছিলাম নদীর সন্ধানে। জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ি নদী। অনেক দূর থেকেই কানে আসছিল কলতান। বুঝতে পারছিলাম না কোন বনান্তের অন্তরালে শুয়ে আছে আমার একলা নদী—রংপোখলা। সে যেন ছিল এক অজানা উৎকণ্ঠা। কিভাবে দেখব তাকে?
CONTACT – 9836407360
বাঁকাচোরা পাহাড়ি পিচরাস্তা ছেড়ে গাড়ি নামতে লাগলো নুড়ি বিছানো ঢাল বেয়ে। অতি সন্তর্পণে। চোখে পড়লো এক ঝলক তরঙ্গিণী। একটানা কুলুকুলু শব্দ।

গাছগাছালির পোশাক গায়ে পাহাড়ের কোলে নিজেকে যেন স্বেচ্চায় বিছিয়ে দিয়েছে রংপোখোলা। গাড়ি ধীরে ধীরে নেমে এল নদী খাতে। চারিদিকে ছড়ানো অসংখ্য নুড়ি-পাথর। কিছুটা জল মাড়িয়ে গাড়ি এসে থামলো নদীর মাঝখানে। সেখানে জল নেই। শুধু নুড়ি-পাথর আর ঝিকিমিকি সাদা বালি। তারপর আবার জল। বয়ে চলা হাঁটুজল আর জল ডিঙানো বাঁশ আর কাঠের একটা ছোট্ট সাঁকো। তার ওপারে নদীর গায়েই আমার দুদিনের অস্থায়ী ঠিকানা। সেই ঠিকানার চারিদিক সবুজে ঢাকা, পাশে এলোচুল নদী।

দু’দিন ছিলাম নদীর বাড়িতে। দুটো গোটা দিন। শুনেছিলাম অবিরত নদীর গান, খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম তাকে। কখনও খোলা জানালার পাশে বসে, কখনও বা বড় পাথরের ওপর গুটিসুটি হয়ে বসে। প্রতিটা মুহূর্তেই টের পাচ্ছিলাম এক অদ্ভুত অন্তহীনতা।
দু’পাশ পাহাড়ে ঘেরা, গাছগাছালিতে ভরা, গাঢ় নিস্তব্ধতা। মনে মনে বারবারই ভাবছিলাম – অজানা, অখ্যাত নদী আমার, একলা নদী আমার, বহমান।
সেদিন দুপুরের খাওয়া সেরে বসেছিলাম নদীর ধারে, একটা বড় পাথরের ওপর। টের পাইনি কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছিল। পাহাড়ের ওপর গাছপালা ডিঙিয়ে সূর্য পশ্চিমে তলিয়ে গেছে। গাছের ফাঁকে ফাঁকে শেষ বিকেলের আলোর লুকোচুরি। শান্ত জঙ্গল, মৌন পাহাড় – সাথে নদীর গান শুনতে শুনতে আমি ক্রমশ মগ্ন হয়ে যাচ্ছিলাম এক দুর্লভ নিস্তরঙ্গতায়।

নদীর পাড় ধরে একটা পায়ে চলা রাস্তা। জঙ্গলের ভেতর ভেতর দিয়ে চলে গেছে অনেক দূর। উদ্দেশ্যহীনভাবে ধরলাম সেই পথ। অদ্ভুত এক বুনো গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ। গাছেদের প্রত্যেকটা পাতা যেন নেশাচ্ছন্ন। পাখিদের ঘরে ফেরার গান জানান দেয় এখুনি ফুরিয়ে যাবে আরও একটা দিন, ঝুপ করে নেমে আসবে সন্ধ্যে। সারি সারি গাছ, ঝোপ জঙ্গল, নদীর বুকের পাথরেরা, ছড়ানো নুড়ি, বালি—সবই যেন সেই আশঙ্কার অপেক্ষায়। নিশ্চুপ অপেক্ষা আরও একটা সন্ধ্যের।

সেদিন একবারও ফিরে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিলনা। মনে হচ্ছিল এগিয়ে যাই, কেবল এগিয়ে যাই, জেনে আসি নদীর শেষ। ‘নদীর শেষ’—ভাবনাটা যেন খান খান করে দিল আমার চেতনাকে। নদী কি আদৌ কখনও শেষ হয়? শেষ জানলে যে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। রহস্য হারিয়ে যায় স্বাভাবিকতায়। পায়ে পায়ে ফিরে চলি আমার অস্থায়ী আস্তানার দিকে। গাছপালারা তখন ডুব দিয়েছে মনকেমনের আবছায়ায়। তারার ডালিতে আকাশ, আলোর ফোঁটায় ফোঁটায় ছোট ছোট পাহাড়ি জনপদ জানান দিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। আমি ফিরে এসে দাঁড়ালাম বাঁশের সাঁকোর ওপর।

একটা ছাউনীর টিমটিমে আলোর নিচে বসে থেকে অনেক রাত অবধি দেখছিলাম অন্ধকার। অন্ধকার গলে গলে পড়ছিল নদীর বুকে, পাহাড়ের চূড়ায়, গাছে গাছে। নীরব তারারা যেন গা ভাসিয়েছে প্রাত্যহিকতায়। সময় যেন বয়ে চলেছিল নির্বিকারভাবে, প্রকৃতির নির্মাণ যেন প্রকৃতি নিজেই ভেঙ্গে ফেলছিল নিঃশব্দে, রাতের অন্ধকারে। হঠাৎ-ই যেন ভীষণ ভালো লাগতে শুরু করল। অন্ধকার ভেঙ্গে নেমে গেলাম নদীর বুকে। নদীকে ছুঁলাম আমার দু’হাত দিয়ে আর ফিসফিস করে তার কানে কানে বললাম— ও রংপোখলা, আমার একলা নদী, আমি আবার ফিরে আসব তোমার কাছে। আমি নিজেকে হারাবো তোমার নুড়ি – পাথর – বালি আর দু’ধারের গাছগাছালির আদিমতায়। আমি আবার একলা হবো তোমার সাথে কোন একদিন’।

Adhunik Bangla Gan Ambika Ghosh benaras Bengal bengali short story coronavirus Dakshinee dreams Durga Puja Emotions folk culture Himalaya History of Indian Music India indian politics Kashmir Kobita kolkata kothabriksha kothabriksha editorial lockdown Music Nature nilimesh ray Pratyay Pratyay Raha pritam chowdhury pujo shonkhya Rabindranath Rabindranath Tagore Rabindrasangeet Religion Sayandeep Paul sharodiya shonkhya shortstory society Srabanti Sen Stories Subha Guha Thakurta Sustainable Travel Suvo Guha Thakurta Theatre travel west bengal World Environment Day