গ্রামীণ লোকশিক্ষায় অবিরত কাজ করে চলেছে ‘সিদো কাহ্নু মিশন’ – পুরুলিয়ার আঢ়ষায়

পুরুলিয়া – নামটা শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে লালমাটি, পলাশ গাছ, দিগন্তে দাঁড়িয়ে থাকা অযোধ্যা পাহাড়ের এক নিরাভরণ রুক্ষ নগ্ন মূর্তি… আর তার বুকে বাসা বেঁধে থাকা ভারতের বিভিন্ন আদিম উপজাতি অধ্যুষিত বহুগ্রাম। বেশ কিছুদিন আগেই কথাবৃক্ষ পৌঁছে গিয়েছিল পুরুলিয়ার ‘আঢ়ষা’ ব্লকের ‘ভালিডুংরী’ নামক একটি আদিবাসী গ্রামে যেখানে রয়েছে ‘সিদো কাহ্নু মিশন’ নামক একটি আশ্রম-স্কুল।

এই গ্রামটি অযোধ্যা পাহাড়ের ঠিক পিছন দিকে অবস্থিত। এই অঞ্চলে গেলেই বোঝা যায় যে মানুষ কতটা সংগ্রামী হতে পারে। এখানকার ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশেই এখানকার মানুষদেরকে আরও কঠোর পরিশ্রমী, সংযমী ও সংগ্রামী করে তুলেছে।
সিদো কাহ্নু মিশন – এর প্রতিষ্ঠাতা নরেন হাঁসদা। সেই সঙ্গেই তিনি একজন সাঁওতাল লোকগানের গীতিকার এবং সুরকারও বটে।

এই মিশনের মূল উদ্দেশ্য আমাদের সমাজের পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের একটা সুস্থ সংস্কৃতি এবং শিক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কথাবৃক্ষ – এর পক্ষ থেকে এই আশ্রমে বেশখানিকটা সময় কাটিয়েছি আমরা এবং স্কুলটি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের তরফ থেকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছি এবং আগামীদিনেও সাহায্য করার সংকল্পবদ্ধ হয়েছি। আমাদের সম্পাদকরা নরেন বাবুর সঙ্গে কথা বলেছেন আশ্রমের বিভিন্ন খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে। রোজকার সংগ্রামের ইতিহাসের এক টুকরো গল্পই ফুটে উঠেছে এই অঞ্চলের লোকশিল্পী ও ‘সিদো কাহ্নু মিশন’-এর প্রতিষ্ঠাতা নরেন হাঁসদা’র সঙ্গে আমাদের কথোপকথনে।

নরেনবাবুর সাথে সাক্ষাতকারে কথাবৃক্ষের সহসম্পাদক প্রীতম চৌধুরী

১. আপনি যদি আপনার এই বিদ্যালয় স্থাপনের আদর্শ বা ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলেন আমাদের। কি ভাবনা থেকে এই বিদ্যালয় শুরু করেছিলেন? 

সে অনেক গল্প। ২০১০-১১ মধ্যে এখানে আসি, এখানে তখন ঘর ছিল না, একটা গাছের তলায় থাকতাম। আমি একাই প্রথম এসেছিলাম তারপর আমার সঙ্গীকে পাই এক বছর পর, নাম মুচিরাম হেমব্রম। ও আমাকে খুব সঙ্গ দিয়েছে, এখনো দেয়। নদীর ধারে থাকতে থাকতে এই ঘরটা করেছি, প্রায় দেড় বছর পর। গান গাইতাম, জানতাম না যে এই ইস্কুল হবে, মনে হতো পারবো কি আমি ইস্কুল করতে? একবার একটা বাচ্চা এসে বলে “আমাকে রাখবি তোর সঙ্গে ?”
আমি জিজ্ঞেস করি “তুই পড়িস?”
সে বলে “না ছেড়ে দিয়েছি”
আমি বলি “তুই পড়বি, তোকে পড়াবো।” ওকে নিয়ে এসে স্কুল এ ভর্তি করে দিলাম। তার পরের বছর আরো দুটো বাচ্ছা এলো, এই করে করে এখানে এখন ২৮ টা বাচ্ছা । এরা সকলেই  অনাথ, বিভিন্ন ব্লক থেকে এসেছে।

২. এই বাচ্চারা কোথায় থাকে?

যারা স্টুডেন্ট সবাই এখানেই থাকে। এই জমিটা লোসারাম টুডু দিয়েছেন, উনি একসময় রেডিও তে গান করতেন। কোনো কারণে এখন আর করেন না। আমরা একসাথে বিভিন্ন জায়গায় যাই ,অনুষ্ঠানে যাই।

৩. আপনি তো একজন সঙ্গীত শিল্পী, আপনার গান এই স্কুলকে এবং স্কুলের বাচ্ছাদের কিভাবে সাহায্য বা উদ্বুদ্ধ করেছে সেটা যদি একটু বলেন। 

গান হচ্ছে আমার পুঁজি, গান নিয়েই এতো সব করা, গান ছাড়া, এই গাছপালা, সংস্কৃতি ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। আমরা পাহাড়ে প্রচুর গাছ লাগিয়েছি, নল কূপের এক্সট্রা জল আমরা ধরে রাখি, সেই জল বাচ্ছারা দেয় গাছে।   
তারপর ওনার গান ধরলেন..
“নরেন হাঁসদা নামটি আমার জানে অনেক লোকে
গান বাজনা করে জীবন কাটাই বড়ো সুখে দুঃখে.. “
..নিজেই গান লিখি সুর করি, বিভিন্ন জায়গায় গান গাইতে যাই, আর্থিক যা উপার্জন হয় সেটা এখানেই কাজে লাগাই। জীবন যাপন, গাছ বাঁচাও, শিক্ষা পরিবেশ – এই নিয়েই আমার গান।

 ৪. বাচ্ছারা কি কি শেখে এখানে?  

বাংলা, ইংরেজী, সান্থালি, ছবি আঁকা , মাটির জিনিস তৈরী করা, নাচ, গান এই সবকিছুই শেখে এখানে। আরো নতুন কিছু শেখানোর পরিকল্পনা করছি।

৫. ভবিষ্যতের কি ভাবনা আছে? কি কি পরিকল্পনা আছে?

কিভাবে স্কুলটা বড় করা যেতে পারে এই চিন্তা তো আছেই, আপনাদের মতো মানুষ যদি এগিয়ে আসে তাহলে আমরা উৎসাহ পাবো। যারা বড় হচ্ছে তারা হাইস্কুলে চলে যায় আবার আসে এখানে। নারী, শিশু, বাচ্ছারা এখানে থাকে কিন্তু আমাদের কোনো কাগজপত্র নেই, সেগুলো হলে খুব ভালো হয়।   

৬. এতো বড় উদ্যোগ চালাতে কি কি ধরণের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে?

এটা চালানোর জন্য বিভিন্ন জায়গায় আমাকে গান গাইতে হয়। স্কুল, কলেজ, গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে বেড়াই। লোকজনকে আমি বলি, “যদি আমার গান ভালো লাগে তাহলে আমাকে সাহায্য করবেন। যেটুকু আয় হয় সেই দিয়েই সবার খাওয়া দাওয়া চলে। এখানে বাচ্ছা, বিধবা মহিলা সকলেই থাকেন। সাহায্যের জন্য শহরের দাদাদের যোগাযোগ করি, তাই নিয়ে লোকে নানা রকম কথাও বলে, সন্দেহ করে। কিন্তু যোগাযোগ না রাখলে কি করেই বা চালাবো। সরকারি কোনো হেল্প পাইনা, উপরন্তু লোকে ভুল ভাবলে আমরা পরে যাই মুশকিলে। আমরা মানুষকে ভালোবাসি, প্রকৃতিকে ভালোবাসি, সেই ভাবনা নিয়েই বাচ্চাদের বড় করার চেষ্টা করছি।

৭. রাজনৈতিক অসুবিধায় কখনো পড়তে হয়েছে?

রাজনীতির ব্যাপার বলাই যাবেনা, বুঝতেই তো পারেন। কিছু বললেই বলবে নরেন হাঁসদা প্রচার করছে। গান গাইতে যতদিন পারবো আমি, কোনো অসুবিধা হবে না। 

৮. আপনারা দুজন গান গেয়ে মানুষের কাছ থেকে কিরকম আদর পেয়েছেন?

আমরা বিভিন্ন জায়গায় গান গাই। অনেক সাড়া পাই, ছেলে মেয়েরা অনেক কিছু বলে তখন মনে হয় কিছু হয়তো দিতে পারছি সমাজ কে।

৯. এখানকার সব বাচ্ছারা গান শেখে?

হ্যাঁ ,সবাই গান শেখে। লেখাপড়ার সাথে সাথে এটাও তো একরকম শিক্ষা। আমাদের খুবই কষ্টে দিন কেটেছে। গাছের তলায় থেকেছি দু-বছর।  প্রথম প্রথম মানুষ বুঝতো না।  বলতো “কি করছো অনাথ বাচ্ছাদের নিয়ে?এর থেকে মদ বেঁচে তোমার অনেক লাভ হবে “
আমি বলেছি “না, আমি এটাই করবো “
আমি মানুষের সেবা করতে ভালোবাসি। পাহাড়, গাছপালা এইসব নিয়েই আছি……

১০. আশপাশের পরিবেশ কে সুস্থ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা কিভাবে করছেন?

চারদিকটা বেড়া দিয়ে দিয়েছি, অনেক গাছ লাগিয়েছি, নানা জায়গা থেকে চারা জোগাড় করে এগুলো করেছি।

আশ্রমের বাচ্চাদের হাতে লেখা পোস্টার

১১. করোনা পরিস্থিতিতে এই যে সব বন্ধ, সেটার জন্য কি কি অসুবিধা হয়েছে ?

করোনার কারণে আমরা খুবই ভয় পেয়ে গেছিলাম। যখন খবর এলো কেউ কোথাও যেতে পারবেনা তখন সত্যিই খুব ভয় পেয়েছিলাম এই ভেবে যে ৩৮ জনের খাওয়া দাওয়া কি করে চলবে? হ্যাঁ, এখানে আমরা মোট ৩৮ জন থাকি। আমি তো গানের ভরসাতেই থাকি। ভেবেছিলাম না খেয়েই মোর যাবো। তারপর একজন ফোন করে জিজ্ঞেস করে, আমাদের খোঁজ নেয়। আমিও চেষ্টা করছিলাম বিভিন্ন মানুষকে যোগাযোগ করার। কিছুদিন পর কয়েকজন response করলো, বললো চাল, ডাল পাঠাবে। আমি বলেছিলাম “দাদা আমরা রোগে নাই মরবো, মরলে না খেয়ে মরবো। “

১২. এই মুহূর্তে আপনাদের কি ধরণের সাহায্যের দরকার যদি বলেন তাহলে আমরা মানুষজনকে সেভাবে বলতে পারবো।

প্রথমেই আমাদের স্কুলের কাগজপত্রগুলো ঠিক করা দরকার যেটা আগেও বললাম। সব দপ্তরে চিঠি দিয়েছি, সবকিছু জমা দিয়েছি কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি এখনো। এটাতো একটা risk, কিছু হলে সবাই তো আমাকে ধরবে। কোনো বেসরকারি সংস্থা যদি সাহায্য করতে চায় তাহলে ঘর বানাবো। এতগুলো বাচ্চা থাকে, অতিথি এলে থাকার জায়গা দিতে পারিনা।

১৩. এখানে বাচ্চাদের বই, খাতা, পেন্সিল এগুলো কোথা থেকে পান?

পুরুলিয়া থেকে নিয়ে আসা হয়, আবার কেউ কেউ দিয়েও যায়।

১৪. এখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে?

১২ কিলোমিটার দূরে আছে। কেউ অসুস্থ হলে আমাকেই সেখানে নিয়ে যেতে হয়।

১৫. আপনারা শহরের মানুষের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চান?

আমরা লেগে আছি, আমাদের কর্তব্য করে যাচ্ছি। আমরা বোকা সোকা মানুষ, সবাই যদি সবার মতো করে সাহায্য করে খুব ভালো হয়।

এই সাক্ষাৎকারটি শেষ করে যখন আমরা আশ্রমটি থেকে ফিরে আসছিলাম তখন হঠাৎ শুকনো ডালপালা দিয়ে ঘেরা এই আশ্রমটির বেড়ায় একটি পোস্টারে এসে চোখ থমকে গিয়েছিল। সেই হাতে লেখা পোস্টারটিতে লেখা ছিল,
“এখন জলের বতল নিয়ে সবাই ঘুরে,
একদিন পাহাড় জঙ্গল গাছ শেষ হলে অক্সিজেনের বতল নিয়ে ঘুরতে হবে।”

আশ্রমের বাচ্চাদের হাতে লেখা পোস্টার

সত্যিই কী ভীষণ কঠিন একটা সত্য! যেখানে স্বার্থে অন্ধ হয়ে যাওয়া অতি আধুনিক মানব সভ্যতা প্রগতির নামে আমাজন অরণ্য কে দাবানলে ছারখার করে দেয়, অস্ট্রেলিয়ায় ধ্বংস হয়ে যায় বহু বন্যপ্রাণ, বাঘ শিকার চলে প্রকাশ্য দিবালোকে, অবৈধভাবে হাতির দাঁত আর একশৃঙ্গ গন্ডারের সিং বিক্রি হয় শৌখিনতার নাম করে – সেই আধুনিক সভ্যতার সামনে এই পোস্টারটি যেন কোন এক চরম পরিনতির আয়না তুলে ধরে।

এই কারণেই বোধ হয় ‘আগন্তুক’ সিনেমায় মনোমোহন মিত্রর সংলাপে ফুটে উঠেছিল সেই আফসোস সেখানে তিনি সভ্য সমাজে জন্মগ্রহণ করার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করেছিলেন। এই সাক্ষাৎকার আমাদেরকে সেই অনুশোচনায় দগ্ধ করুক এবং সচেতন করে তুলুক তবেই বিশ্ব পরিবেশ দিবস সপ্তাহ পালনের চাইতে যথার্থরূপে সর্বান্তঃকরণে লালিত হবে।

সাক্ষাৎকারঃ প্রীতম চৌধুরী অনুলিখনঃ শ্রীতমা বসু

Adhunik Bangla Gan Ambika Ghosh benaras Bengal bengali short story coronavirus Dakshinee dreams Durga Puja Emotions folk culture Himalaya History of Indian Music India indian politics Kashmir Kobita kolkata kothabriksha kothabriksha editorial lockdown Music Nature nilimesh ray Pratyay Pratyay Raha pritam chowdhury pujo shonkhya Rabindranath Rabindranath Tagore Rabindrasangeet Religion Sayandeep Paul sharodiya shonkhya shortstory society Srabanti Sen Stories Subha Guha Thakurta Sustainable Travel Suvo Guha Thakurta Theatre travel west bengal World Environment Day

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.